সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা।

—মুহাম্মদ সৈয়দুল হক

শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা।

ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ


★প্রারম্ভিকাঃ 

“তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ

দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’

বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা

রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।”


যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর তেজ হাঁরিয়ে বসত! যিনি না এলে নবীজির দেখানো দিশা মতে এ সময়ের পৃথিবী বিখ্যাত দারাজকণ্ঠী আলেমদের মুখনিসৃত ইমান-আকিদার সে সঠিক বাণী এতদিনে হয়ত শুকনো পাতার মর্মম ধ্বনীর মত করেই বাজতো। শুরুতেই স্বরচিত কটি কাব্যিক লাইনের মাধ্যমে আলোচনার মুল কথা তুলে এনেছি। ‘মসলকে আলা হযরত’ তথা ইমাম আলা হযরতের সে পথ ও মত বা মতবাদ সমষ্টিকে যদি গ্রহ হিসেবে কল্পনা করা যায় তবে সে গ্রহসমূহ যে সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে সে সূর্যের নাম ‘ইমাম আলা হযরত’। এটা এ জন্য যে, যে মুহূর্তে ভারতীয় উপমহাদেশসহ পৃথিবীজুড়ে বতুলতার আঁধারে ঘিরে ধরেছিলো, ঠিক ঐ সময়েই সকল বতুলতাকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে এক সুশৃঙ্খল দিশা নিয়ে সূর্যরূপে আভির্ভূত হয়েছেন চতুর্দশ শতাব্দির মহান মুজাদ্দিদ ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)।  আর যে সুশৃঙ্খল দিশা তিনি দান করে গেছেন, আজকের দিনে তা ‘মসলকে আলা হযরত’ নামে সর্বজন বিদিত।


★মসলকে আলা হযরত কী? ‘মসলক’ শব্দের অর্থ- মত, মতবাদ, পদ্ধতি কিংবা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। আর ‘মসলকে আলা হযরত’ বলতে আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান ব্রেলভী (রহ.) কতৃক কুরআন-সুন্নাহর সঠিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত প্রচলিত বিশ্বাস ও কর্মযজ্ঞকেই বুঝানো হয়। উল্লেখ্য যে, ‘মসলকে আলা হযরত’ নতুন উদ্ভাবিত কোন মতবাদ নয়, বরং পূর্ববর্তী সকল হকপন্থিদের পথ ও মত অনুসারে আলা হযরত কতৃক বিশ্লেষিত ও প্রমাণিত আকাইদ ও আমলের পূর্ণাঙ্গ নীতিমালাই মূলত ‘মসলকে আলা হযরত’ নামে পরিচিত। আর ঝিমিয়ে পড়া অসখ্য সুন্নাতের নতুন প্রাণ দিয়ে যিনি এ মহান মসলক দান করে গেছেন, তিনি আলা হযরত (রা.)। যাঁদের ব্যাপারে নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর বাণী হচ্ছে- ﻣﻦ ﺍﺣﻴﻲ ﺳﻨﺘﻲ ﻗﺪ ﺍﻣﻤﺖ ﺑﻌﺪﻱ ﻛﺎﻥ ﻣﻌﻲ فى ﺍﻟﺠﻨﺔ অর্থাৎ, ‘যে ব্যক্তি আমার পরে আমার এমন কোন সুন্নাতকে জীবিত করবে, যা মৃত হয়ে গেছে প্রায়; সে জান্নাতে আমার সাথী হবে।’ নবীজির মহান সে বাণীর প্রেক্ষাপটে ইমাম আলা হযরত যে জান্নাত নামক নেয়ামতে নবীজির সঙ্গত্ব নিশ্চিৎ করে নিয়েছেন, তা তাঁর মসলক গবেষণা করলেই বুঝা যায়। 


সর্বসম্মতিক্রমে আলা হযরত চতুর্দশে শতাব্দির মুজাদ্দিদ ছিলেন। আর মুজাদ্দিদ সম্পর্কে ‘জামিউস সগীর’ নামক কিতাবের প্রথম খণ্ডের ৭৪ পৃষ্টায় সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবি ‘হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে- ان الله تعالى يبعث لهذه  الامة على رأس كل مائة سنة من يجدد لها دينها

অর্থাৎ- ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা প্রতি শতাব্দির শুরুতে এমন একজনকে প্রেরণ করেন(মুজাদ্দিদ হিসেবে), যিনি এ দীনকে নতুনভাবে সংস্কার করেন।’


★মাসলাকে আলা হযরত কি নতুন কোন মতবাদ বা মাজহাব?


উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে এ কথার ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে যে, ‘মসলকে আলা হযরত’ মোটেও নতুন সৃষ্ট কোনো মাজহাব বা মতবাদ নয়। বরং পূর্বযুগের সত্যপথপ্রাপ্ত মনীষীরা যে পথ ও মতের উপর বিশ্বাসী ছিলেন, যে ইমান-আকিদা ও আমলে অটল ছিলেন, তারই ‘আপডেট ভার্সন’ তথা সংস্কারকৃত রূপ হচ্ছে ‘মসলকে আলা হযরত’। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, দেয়াল থেকে রঙ খসে যাওয়া, মাকড়সার জালে জড়িয়ে যাওয়াসহ প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয়ের ফলে অসুন্দর হয়ে পড়া বহু পুরোনো কোন ইমারতে নতুর রঙ লাগিয়ে তার পূর্বসৌন্দর্য ফিরিয়ে আনলে সে ইমারত যেভাবে নতুন করে আবারো নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে পারে, তেমনি ইসলাম নামক খোদায়ী ইমারতের যাবতীয় জঙ তুলে দিয়ে যে নতুন রূপ ইমাম আলা হযরত দান করেছেন, তারই নাম ‘মসলকে আলা হযরত’। এ প্রসঙ্গের ‘ড. আল্লামা ইকবাল (রহ.)’ এর বক্তব্যটিই নির্ভেজাল প্রমাণ বহন করে। সনটি ১৯৩৩। বর্ণনাকারি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাবেদ আহমদ আলি। ইউনিভার্সিটির অন্য এক অধ্যাপক মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান আশরাফ (র.) এক বিশেষ অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছিলেন ড. আল্লামা ইকবাল (রহ.)কে। যথারীতি বক্তব্য শুরু হলো৷ বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি আলা হযরত (রহ.) সম্পর্কে এভাবে বলতে শুরু করলেন- “ভারত বর্ষে শেষ যুগে আলা হযরত (রা.) এর মত প্রজ্ঞাবান মেধাসম্পন্ন ফকিহ ইসলামি আইনজ্ঞ আর জন্মগ্রহণ করেন নি। তাঁর ফতোয়া অধ্যয়নের পর আমি এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, তাঁর ফতোয়ায় তাঁর প্রতিভা, বুদ্ধিমত্তা, উৎকর্ষতা পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে। এবং ধর্মীয় বিষয়াদিতে তাঁর জ্ঞান সমুদ্রের ন্যায়। তাই জ্ঞানের দিক দিয়ে মাওলানা আহমদ রেযা খাঁর ব্রেলভী হলেন যুগের ইমাম আবু হানিফা।” (মাকালাতে ইয়াউমে রেযা, তয় খণ্ড, লাহোর, পৃষ্টা-৭১)


★বিরোদ্ধবাদিদের স্বীকারোক্তিতে দ্বন্দ্বের অবসানঃ

(১) ‘জামাতে ইসলামী হিন্দ’ এর মূখপত্র ‘আল হাসনাতে’ এ কথা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছে। আর তা হলো- ‘এ বক্তব্য সঠিক নয় যে, আহমদ রেযা দীনের মধ্যে এক নতুন দল সৃষ্টি করেছেন। তবে এটা ঠিক যে, ওলামাগণ এ জামাতকে আহমদ রেযার আকিদার কারণে ‘ব্রেরভী’ নামে ডেকে থাকেন। দ্বিতীয়ত ইহাই মূলত হানাফীদের পরিচয়। (আল হাসনাত, রামপুর শাখসিয়াত, পৃষ্টা ৫৪-৫৫, ১৯৭৯ খ্রীষ্টাব্দ)

এ কথা দ্বারা এটা পরিষ্কার যে, মসলকে আলা হযরত মূলত মসলকে হানাফিই। চলুন, আরো দেখে নেয়া যাক।


(২) আলা হযরতের চরম বিরোধী ‘এহসান ইলাহী জাহির’ লিখেছেন যে, আজ যাদেরকে ব্রেলভী বলা হচ্ছে, মূলত তাদের মতাদর্শ ও আকিদা অনেক পুরোনো। যদিও তারা নামের দিকে থেকে নতুন কিন্তু আকিদাগত বহু পুরোনো। (আলবেরে লবিয়া, পৃষ্টা-৭)


(৩) আরেক আলা হযরত বিরোধী ‘শায়খ মহম্মদ ইকরামে’র বক্তব্য হলো, ‘তিনি(আলা হযরত) অত্যন্ত কঠোরতার সাথে প্রকৃত হানাফির কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। (মাওজে কাউসার, পৃষ্টা-৭০)


বিরোদ্ধবাদিদের এসব বক্তব্যে এ কথা দিনের মত পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ‘মসলকে আলা হযরত’ মোটেও নতুন কিছু নয়। বরং এ আকিদা-বিশ্বাস রাসুলুল্লাহর যুগ থেকই স্বীকৃত। আর এটি হানাফি মাজহাবেরই সংস্কৃত রূপ।


★কেন এটিকে ‘মসলকে আলা হযরত’ বলা হয়?

যদি এটি নতুন কোনো ধারা না হয়েই থাকে, তবে সাধারণত এ প্রশ্নটি জাগে যে, তাহলে এটাকে ‘মসলকে আলা হযরত’ বলা হয় কেন? এ প্রশ্নটির উত্তর খান্দানে আলা হযরত, আল্লামা তাওসিফ রেযা খাঁন খুব চমৎকারভাবেই দিয়েছেন।


আল্লামা তাওসিফ রেযা খাঁন, তাঁর লিখিত ‘মাসলাকে আলা হযরত, মসলকে সাওয়ায়িদে আযম হ্যায়’ গ্রন্থে যা উল্লেখ করেছেন, তার বাংলা মর্ম ঠিক এমনটা দাঁড়ায়- খ্রীষ্টিয় উনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতবর্ষে কিছু জ্ঞানপাপী আলেমের উদ্ভব ঘটে। বর্তমান যাদেরকে আমরা দেওবন্দি বলে জানি, ঠিক তাদেরই পূর্বসূরি এরা। তাদের মধ্যে বিশেষ করে ইসমাইল দেহলভী তার ‘তাকবিয়াতুল ইমান’ নামক গ্রন্থে, খলিল আহমেদ আম্বটবি তার ‘বারাহিনে কাতেয়া’ নামক গ্রন্থে, কাসেম নানুতুবি তার ‘তাহজিরুন্নাস’ নামক গ্রন্থে, রশিদ আহমেদ গাঙ্গুহী তার ‘ফতোয়ায়ে রশিদিয়াতে’, আশরাফ আলি থানভি তার ‘হিফজুল ইমান’ গ্রন্থে আমাদের নবিয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে চরম কটুক্তি করেন। বিশেষত নবিজির মর্যাদা, এলমে গায়েব, হাজের নাজেরসহ অসংখ্য যোগ্যতাকে তাদের ঐসব কিতাবে অত্যান্ত খাটো করে উল্লেখ করেছেন। খলিল আহমেদ আম্বেটবি তো রাসুলুল্লাহর এলমের চেয়ে শয়তানের এলম বেশি বলেই দাবি করেছেন। আর কাসেম নানুতুবি সরাসরি ‘খতমে নবুওয়াত’কেই অস্বীকার করে বসেছে। আর মির্যা গোলাম কাদিয়ানি তো ভ্রান্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে নিজেকে নবি পর্যন্ত দাবি করে বসেছে। নাউজুবিল্লাহ!


কথা হচ্ছে এতসব বেআদবি-গোস্তাকির পরেও কেউ এদের বিরোদ্ধে বলতে-লিখতে সাহস করেন নি বা বলেন নি, লিখেন নি। কিন্তু বিপরিতে একমাত্র আলা হযরতই (যিনি মাত্র আটবছর বয়সে হেদায়তুন নাহুর শরাহ এবং তের বছর বয়সে যাবতীয় পাঠ চুকিয়ে ফতোয়া লেখা আরম্ভ করেছিলেন। ‘হায়াতে আলা হযরত’ দ্রষ্টব্য) এসব ভ্রান্ত আকিদার বিরোদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তিনি আল্লামা ফজলুল হক বাদায়ুনি (রহ.)’র লিখিত কিতাব ‘আল মু’তাকিদুল মুস্তানাদু’ এর টিকা ও সূচিপত্র লিখে, সেখানে উল্লেখিত প্রথম পাঁচজনের নাম ও তাদের আকিদাগুলো সংযোজন করে ২১ জিলহজ ১৩২৩ হিজরিতে পবিত্র মক্কা ও মদিনা শরিফের বিখ্যাত আলেমদের নিকট প্রেরণ করেন। সেখানকার তৎকালিন বিশ্ববিখ্যাত আলেমরা উক্ত পাঁচজনের উপর কুফুরি ফতোয়া প্রদান করে রায় দেন যে, ‘‘من شق فى كفره وعذابه فقد كفر’’ অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি তাদের কাফের ও আজাব হওয়াতে সন্দেহ পোষণ করবে সেও কাফের।’


পরবর্তীতে আলা হযরত (রা.) সে ফতোয়াতে উক্ত পাঁচজনের বিরোদ্ধে কুফুরি ফতোয়ার পক্ষে দলিল ভিত্তিক নিজের মতামত যুক্ত করে ‘হুসামুল হারামাইন কুফরে ওয়াল মাঈন’ নাম দিয়ে তা প্রকাশ করেন। সে ফতোয়ায় যারা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাদের মধ্য হতে বিশেষ কজনের নাম নিম্নরূপ-

(১) মাওলানা ইসমাঈল মক্কী। মোহাফেজে হারাম শরীফ, মক্কাতুল মুকাররামাহ।

(২) মাওলানা হাসান ইবনে মুহাম্মদ৷ হারাম শরীফ।

(৩) শায়খ আবদুল কাদির। মসজিদে নববি, মদিনা মুনাওওরাহ।

(৪) শায়খ ওমর ইবনুল মুস্তফা। মদিনা শরীফ।

(৫) শায়খ আলি ইবনে আলি আর রহমানি। মসজিদে নববি, মদিনা মোনাওওয়ারাহ।


শুধু তাই নয়, ঐ সময়ে উদ্ভাবিত শরিয়তের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে আলা হযরত ছিলেন ‘অন্ধের যষ্ঠি’ তথা মুসলিম মিল্লাতের একমাত্র উপায় সরূপ। যা আজ বিশালাকার ‘ফতোয়ায়ে রেজবিয়্যাহ’ দেখলেই সহজে অনুধাবন করা যায়। আল কুরআনের বিশুদ্ধতম অনুবাদগ্রন্থ ‘কানযুল ইমান’, এলমে গায়েবের উপর মাত্র আটঘণ্টায় লিখিত ‘আদদৌলাতুল মক্কিয়্যাহ বিল মাদ্দাতিল গায়বিয়্যাহ’,সহ ঐসব নর্দমার পঁচা আকিদার বিপরিতে তিনি বহু কিতাব রচনা করে তাদেরকে দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রদান করেছিলেন। কথিত আছে, তাঁর রচিত কিতাবের সংখ্যা হাজারেরও উপরে। কেউ কেউ বলেছেন প্রায় চৌদ্দশত, সুবহানাল্লাহ! সুতরাং ঐ সময়ে বাতিলদের বিরোদ্ধে এভাবে সঠিক ইমান-আকিদার জন্য লড়ে তা মুসলিম মিল্লাতের মাঝে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই তাঁর নামে সম্বোধন করে এসব আকিদাপন্থিদের ‘ব্রেলভী’, ‘রেজভী’, বা ‘মসলকে আলা হযরত’পন্থি বলে অভিহিত করা হয়। আর প্রমাণিত সত্য যে, এটিই সঠিক মসলক তথা কুরআনের ঘোষিত ‘সীরাত্বাল মুসতাকিম’ তথা সহজ সরল পথ।

(মাসলাকে আলা হযরত, মসলকে সাওয়ায়িদে আযম হ্যায়’ কৃত- আল্লামা তাওসিফ রেজা খাঁন, পৃষ্টা ৭-১৩)


★মসলকে আলা হযরত নবিপ্রেমিদেরই মসলকঃ মসলকে আলা হযরতের মুলমন্ত্র হলো সৃষ্টিজগতের সবকিছুর চেয়ে প্রিয় নবিজির প্রেম সর্বাধিকভাবে বুকে ধারণ করা। যেমনটি ইমামে আলা হযরতের মালফুজাতের মধ্যে পাওয়া যায়- 

(১) তাওহীদ এর দু'টি রূপ: এক- তাওহীদ ই-এলাহী অর্থাৎ আল্লাহ এক, তাঁর সত্ত্বা ও গুণাবলীতে কোন অংশীদার নেই। দুই, তাওহীদ-ই-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অর্থাৎ তার সমস্ত গুণাবলী গোটা সৃষ্টিজগত থেকে ভিন্ন।


(২) “সারা জীবনের ইবাদত একদিকে, আল্লাহর রাসুলের ভালোবাসা আর একদিকে। যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা না হয়ে থাকে তাহলে সমস্ত ইবাদত ও সাধনাই নিরর্থক।” (মালফুজাতে আলা হযরত, সংকলক- শাহজাদায়ে আলা হযরত মুফতি আল্লামা মুস্তফা রেযা খান ব্রেলভী। সূত্র- আল মুখতার, ১৪৩৯ হিজরি)।


আর হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেও ঠিক এমনটি বর্ণিত হয়েছে। হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবিজির ইরশাদ- “لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكونَ أحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِه وَالنَّاسِ أَجْمَعينَ "(متفق عليه)”

অর্থাৎ- “তোমরা কেউ ততক্ষণই পূর্ণ ইমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজ, পিতা-মাতা, সন্তানাদিসহ সকল মানুষের চেয়ে আমাকে অধিক ভালো না বাসবে।” (মিশকাত, বুখারি ও মুসলিম শরিফ হতে বর্ণিত)


চলুন, এবার আলা হযরত (রা.) এর নবিপ্রেমের কিছু নমুনা নিয়ে আলোচনা করা যাক, যে নমুলাগুলো এখনো নবিপ্রেমিকদের নবিপ্রেমের পরিপূর্ণতাতে সাহায্য করে। 


 (১) শয়নপদ্ধতিঃ ইমাম আলা হযরত ঘুমানোর ক্ষেত্রেও প্রিয় নবিজির প্রেমে মশগুল থাকতেন। বর্ণিত আছে, তিনি যখন ঘুমাতেন, তখন তাঁর শরিরের আকৃতি محمد শব্দের অবয়বে গঠন করেই শয়ন করতেন। (হায়াতে আলা হযরত, ৯৯পৃষ্টা, মাকতাবাতুর মদিনা প্রকাশনী)


(২) মদিনা শরিফে জাগ্রত অবস্থায় নবিজির দিদার লাভঃ আলা হযরত (রা.) যখন দ্বিতীয়বারের মত হজ্বে গিয়ে মদিনা শরিফে গেলেন, সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকেও নবিজির দিদার না পেয়ে লিখা শুরু করলেন- 

‘ওহ চুয়ে লালা যার পিরতে হ্যায়

তেরে দিন এ বাহার পিরতে হ্যায়’

এ কালামটি লিখতে লিখতে শেষে অভিমানি মনে তিনি লিখে বসেন-

‘কুয়ি কিঁউ পুছে তেরি বাত রেযা

তুঝছে কুত্তে হাজারো পিরতে হ্যায়’ 

(হাদায়েকে বখশিশ, পৃষ্টা-৬০)

প্রেমাষ্পদ পৃথিবীর অপরপ্রান্থে থাকলেও প্রেমিকের বাঁশির সুরে তাঁর হৃদয়কে ঠিকই আন্দোলিত করে। আর আলা হযরতের এ লিখাটি লিখার ঠিক পরপরই নবিয়ে দোজাহাঁ আলা হযরত (রা.) কে ঐ অবস্থায় দিদার দানে ধন্য করেন, সুবহানাল্লাহ! (হায়াতে আলা হযরত, পৃষ্টা-৯২, মাকতাবাতুল মদিনা প্রকাশনী)


(৩) নবিপ্রমে রচিত কাব্যমালাঃ আলা হযরত (রা.) কেবল মুজাদ্দিদ বা বিশ্ববিখ্যাত আলেম ছিলেন তা নয়, তিনি বড়মানের কবিও ছিলেন বটে। তাঁর রচিত অমরগ্রন্থ ‘হাদায়েকে বকশিশ’ এর কাব্যমালা এখনো নবিপ্রেমিদের বুকে কাঁপন তুলে চলে। আজকের নবিপ্রমিকদের অন্তরের খোরাক। যে কাব্যমালা সম্পর্কে হুজুর কেবলা আল্লামা তৈয়ব শাহ (ম.জি.আ.) বলেছেন- ‘যাঁর কাছ থেকে এ ধরনের হৃদয়াগ্রাহী মর্মস্পর্শী কাব্য বের হতে পারে, না জানি তাঁর অন্তরে কীরূপ অবস্থা বিরাজ করছে। নিশ্চয় তিনি ফানাফির রাসুলের মর্যাদায় অভিষিক্ত।’ (পায়গামে ইয়াউমে রেযা, লাহোর, পৃষ্টা- ৩১)


 সেসব নাতে রাসুলের মধ্যে হলো-

‘ছবছে আওলা ওয়ালা হামারা নবী

ছবছে বালা ওয়ালা হামারা নবী’

‘মুস্তফা জানে রহমত পে লাখো সালাম

শময়ে বঝমে হেদায়েত পে লাখো সালাম’

‘জমিনু জমা তুমহারে লিয়ে

মকিনু মকা তুমহারে লিয়ে’

‘লাম ইয়াতি নাযিরুকা ফি নাঝরিন

মিছলে তুনা শুধ পয়দা জানা’সহ অসংখ্য নাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘হাদায়েকে বখশিশ’ নামক কাব্যগ্রন্থে সোনালি অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। নিত্য বেজে চলেছে নবিপ্রেমিকদের অন্তরে। অন্তরে থেকে মুখ হয়ে উপমহাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা নিত্যই আবৃত্তমান। বস্তুত, আলা হযরত এসব লেখনির মাধ্যমে মানুষদের মাঝে নবিপ্রেমের জোয়ারই সৃষ্টি করেছিলেন। অতএব, তাঁর সে দেখানো পথ ও মত তথা মসলকের যারা অনুস্মরণ করে, বাস্তবিক পক্ষে তারাই সত্যিকারের নবিপ্রেমিক। সুতরাং বলা যায়, এটি নবিপ্রেমিদেরই মসলক।


★যবনিকাঃ সূর্যের তেজ সর্বযুগে অপরিবর্তনশীল। বছরের পর বছর তা একইরূপে আলো বিলিয়ে থাকে। দিনান্তে সূর্য পৃথিবীর অপরপ্রান্থে চলে গেলেও পৃথিবীর স্থিতিশীলতা ঠিকই বজায় থাকে তার তাপদাহের কারণেই। আলা হযরত (রা.) সূর্যতুল্য। তিনি গত হয়েছেন আজ শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি যে মশাল জ্বালিয়ে গেছেন, পৃথিবীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা আজো সেই একইভাবে জ্বলছে। আর সে দীপ্তিমান আলোকরশ্মির নাম ‘মসলকে আলা হযরত।’ সে সূর্যরশ্মির বিভিন্ন শাখা ‘কানযুল ইমান’, ‘ফতোয়ায়ে রজবিয়্যাহ’, ‘আদদৌলাতুল মাক্কিয়্যাহ’, ‘হাদায়েকে বকশিশ’ ইত্যাদি। আর সে ‘মসলক’ নামক সূর্যের কক্ষপথ ‘মদিনা’ নামক ‘গ্যালাক্সি’কে ঘিরে আবর্তিত। অতএব এই মসলক সেই মদিনা ওয়ালারই দেখানো ‘সিরাত্বাল মুস্তাকিম’। কবিতার ভাষায় শেষ হোক-

‘এই সেই জ্ঞানধারা, এই সেই পথ

দানিয়াছেন যে পথ নবি হযরত।’


গ্রন্থসূত্রঃ

(১) হায়াতে আলা হযরত। মাকতাবাতুল মদিনা হতে প্রকাশিত।

(২) মাকালাতে ইয়াউমে রেযা, লাহুর।

(৩) মাসলাকে আলা হযরত মসলকে সাওয়াইদে আযম হ্যায়। কৃত, আল্লামা তাউসিফ রেযা খান (ম.জি.আ.)

(৪) মালফুজাতে আলা হযরত। সংকলক, মুফতি আল্লামা মুস্তফা রেযা খান ব্রেলভী।

(৫) পয়গামে ইয়াউমে রেযা।

(৬) হাদায়েকে বখশিশ।

(৭) আল মোখতার। আলা হযরত কনফারেন্স ১৪৩৯ হিজরি সংখ্যা।

(৮) সুন্নিয়তের পঞ্চরত্ন। কৃত, আল্লামা বদিউল আলম রেজভি।

(৯) আলা হযরতের জীবনি ও কারামত। কৃত, শামসুল আলম নঈমী।

(১০) ইমাম আহমদ রেযা (রা.) এর জীবনি। কৃত, মাওলানা ইলিয়াস আত্তার কাদেরি রজভী।


লেখক: —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক

শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা।

শ্রেণি: ফাযিল প্রথম বর্ষ (ফলপ্রার্থী)

মোবাইল: ০১৮৩৭১২৭১৭০

 E-mail: saidulhoque060@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...