সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১

–মুহাম্মদ সৈয়দুল হক


“হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।” 


গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে–

“সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া

সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে

মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা

কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে?

গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...”


রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন–

“নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার

এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও

দয়াল ভাণ্ডারি মোরে তরাইয়া লইয়ো।”


একেকটা গান পড়ুন আর হারিয়ে যান অতল সমুদ্রে। কখনো কখনো মাথা হ্যাংক হয়ে যাবে। যুক্তি কিংবা দলিলের বিচারে মিলাতে পারবেন না। কারণ ওখানে ১+১=২ হয় না, ১+১=১ হয়ে যায়। এটাই মারেফত। গভীর রহস্য, গভীর জ্ঞান, গভীর সিন্ধু।


একাডেমিক যোগ্যতা বলতে কিছুই ছিল না। তো কীভাবে লিখলেন? এত ধনরত্ন পেলেন কোথা থেকে? রহস্য খুব দূরে নয়। শুরুর দিকেই ঝিকঝিক করছে। হজরতের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই পেয়েছেন। ঐ যে, সিনায় সিনায়।


সময়ের অন্যতম সেরা ফকিহ আমিনুল হক ফরহাদাবাদি। আজহারে বর্তমান তাঁকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। মাইজভাণ্ডারি রীতিনীতি নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। একদিন জেদ ধরলেন। মাইজভাণ্ডার যাবেন। হজরতকে ধরাশায়ী করবেন। গেলেন, ধরাশায়ী করার বদলে হয়ে ফিরলেন। ‘সিজদায়ে তাজিমি’ বন্ধ করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করে আসলেন। স্বতন্ত্র কিতাবও লিখে গেছেন। 


সিজদা নিয়ে মতানৈক্য আছে, থাকবে। (একান্তই আমার ভাবনা) তবে যারা মূলে পৌঁছাতে পারেনি তাদের না দেয়াই উচিত। সর্বসাধারণের জন্য শরিয়তের হুকুম মেনে চলাই উচিত। তরিকত বিদ্যুতের মত, এদিক-সেদিক হলেই আপনি শেষ। 


পাক্কা মেকানিকরা সরাসরি বৈদ্যুতিক তার ধরে কাজ করতে পারে, আপনি পারবেন? কৌশল তাদের জানা, কীভাবে, কোন জায়গায় হাত দিতে হয়। অথবা শর্ট খেতে খেতে শর্টটা আর শর্ট নেই। অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অতএব আগে তরিকতের ভাণ্ডারে ডুব মারুন, পরিণত হোন, অভ্যস্ত হোন।


রমেশ বলেছেন-

“সাধনের কায়দা জানা চাই, 

বেকায়দায় করলে সাধন মাওলা রাজি নাই।”

সাতার না জেনে পুকুরের মাঝে গেলে ডুবে মরতে পারেন। তাই আগে সাতার শিখুন। আমিনুল হকরা এলম-হেলমে পরিপূর্ণ ছিল, রমেশরা সোহবতে দিনগুজার করেছিল বলেই সিজদা মেরে ধন কুড়িয়ে পেয়েছেন। আপনি আগে আমিনুল হক হয়ে উঠুন। তারপর সিজদা মারুন বা ‘আনাল হক’ বলুন– নো প্রবলেম। 

“তোর খোদা তোর সঙ্গে আছে চিনে লও তাঁরে

জ্ঞান নয়নে দৃষ্টি কর হৃদয় মাজারে...”


স্কুলের কথা বলছিলাম। আমজনতা থেকে শুরু করে খ্যাতিমান পর্যন্ত। সবাই ছাত্র। যারা হজরতের পক্ষ থেকে খেলাফত পেয়ে অলি-আবদাল হয়েছেন। তাদের লিস্ট সামনে আনা হোক। সবাই সময়ের খ্যাতনামা মুফতি, মাওলানা, মুহাদ্দিস, মুফাস্সির। কেবল ‘কালা সোনা’ নামে খ্যাত পটিয়ার শাহ আমিরুজ্জামান রহ. ব্যতীক্রম ছিলেন। হজরতের বেলায়তি পাওয়ারে পরবর্তীতে তিনিও জবরদস্ত আলেম! 


“মাইজভাণ্ডারে কী ধন আছে চামড়ার চোখে দেখবি না

পেঁচারও ভাই নয়ন আছে দিনে দেখে না।”

আবু লাহাব সামনে থেকেও নবিরাজকে চেনে নি, ওয়াইস করনি দূরদেশ থেকে জোব্বা পেয়ে বসেছে। কাছাকাছি থেকেও তাই চেনা সম্ভব না, যদি না অন্তরচক্ষু খোলা যায়। ভ্রান্তির বেড়াজালে তাই কাছের অনেকেই জড়িয়েছে। দূর মুলুক থেকে এসে আবার অনেকে আবদাল হয়ে ফিরেছে। 


হজরতের উক্তি–

“যদি তুমি আমার সম্মুখে থেকেও স্মরণে বিচ্যুত হও, তবে তুমি ইয়ামেনে। আর যদি ইয়ামেনে থেকেও স্মরণে থাকো, তবে তুমি আমার সামনেই।” ওয়াইস করনির জোব্বা পাবার কাহিণী ওখানেই। প্রেম, স্মরণ, মগন, সপন। এসবে মজতে হবে। ডুব দিতে হবে। তবেই সিনায় সিনায় পাওয়া সম্ভব। হাঁ, এখনো সম্ভব। খবর নিয়ে দেখুন- কতজনে লুটে চলেছে। শেরে বাংলার দিওয়ানে আজিজ খুলুন। ওখানে লেখা আছে– “তেরি দর পর জু আয়া, উসকো দৌলত মিলগেয়্যি” জি হাঁ, হজরতের স্কুলের ধারা এটিই।


পাগল বলুন, গালি দিন, নিন্দা করুন। ঐ নিন্দা গায়ে মাখলে তো! গোলাপের নিন্দা করুন। ফলাফল কী? আপনিই গোলাপের সুগ্রাণ থেকে বঞ্চিত। গোলাপের ক্ষতি? ভাবতেও যাবেন না। ভাবাতেও পাপ! রমেশের সুর মনে বাজছে–

“আমার প্রাণে খোঁজে মাইজভাণ্ডার,

নিন্দা করলে ক্ষতি কী আমার,

নিন্দুকেরা নিন্দা করুক, নিন্দা করা স্বভাব তার,

নিন্দা করলে ক্ষতি কী আমার?”...

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...