সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা
     (শুভ জন্মদিন)

যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷

হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা দেলাওর হোসাইন। হোসাইনি মেজাজ। ছেলেকে হুজরায় ডেকে সাওয়াল জাওয়াব শুরু। পুত্রের সাওয়াল—“হযরত কেবলা কে? বাবাজান কেবলা কে?” বাবা জবাব দেয়—“আল্লাহর অলি, দুয়ে মিলে এক।” প্রশ্নের পরিধি বাড়ে। বাবাকে জিগান বাবার পরিচয় কী? গাউসের অছি—অছি-এ গাউছুল আজম। মেজাজ চটে যায়। “আমি কে চেনো না? আমাকে দেখবে? কী যেন ঘটে তারপর... দরজা খোলা হয়। পিতার মুখমণ্ডল রক্তিম। পূত্র কোনোরকম বসে আছে। টলে পড়ার উপক্রম। শরীরের অবস্থা বেগতিক।

পরদিন হযরতের রওজায় লম্বা সিজদা। প্রায় দুঘণ্টা৷ লোকে জানতে চায়—কী ঘটেছে গতকাল। যুবক এভাবে সিজদাবনত কেন? অছি-এ গাউসুল আজম উত্তর করেন—“আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিরক্ত করছিলো। মেজাজ চটে গিয়েছিল। তাঁর উপর যা ঢালা হয়েছে তা পাহাড়ে ঢাললে পাহাড় টলে যেত। সাগরে ঢাললে তা জনশূন্য মরুভূমি হয়ে যেতো। হযরতের রক্তধারা বলে সে টিকে গেছে।” যুবকের বর্ণনা মতে তাঁর সিনা জ্বলেপুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।

যুবকের নাম জিয়াউল হক। নামের অর্থ হকের জ্যোতি। সত্যের আলোকবর্তিকা। নামের প্রভাব না-কি বংশের স্বভাব—কী জানি! সত্যের জন্য ছোটেন। খোদায়ী রহস্য তাঁর জানা চাই৷ মহাসত্যের সন্ধানে সদা উন্মুখ। আচরণে সবাই উদ্ধিগ্ন। কখন কী করে বসে—তার হিসেব নেই। পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে দরবারের ভক্তকুল—সবাই চিন্তিত। তিনদফা স্বপ্ন দেখে তিন ভক্ত। স্বপ্নে হযরত আসেন, আসেন বাবাজান কেবলাও। অভয় দেন। সুখবর শোনান—“টেনশনের কিছু নাই, তাকে আলোকবর্তিকা-রূপে তৈরি করা হচ্ছে।” সাধকপুরুষ সাধনসিদ্ধ হয়। হযরত কেবলা যুবকের পিতাকে স্বপ্নে আদেশ দেন—“জিয়াউল হক মিঞাকে আমার আমানত অর্পণ করো”। ব্যাস, তাঁর গায়ে হযরতের চাদরজোড়া জড়ানো হয়। চাদর নয়, যেন হযরতকেই সর্বাঙ্গে জড়ালেন। স্বপ্নে এসে তাজও পরালেন হযরত। সাধক জিয়াউল হক পৌঁছে গেলেন অভীষ্টে। তাঁর তিনিকে তিনি তাঁর মত করে দেখলেন, চিনলেন, জানলেন। অতপর ফরমালেন, “নিজের ভেতর দৃষ্টি দাও, বহির্জগতের চেয়েও সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাবে”।

তারপর...? আর কী? বেলায়তী কাণ্ডকারখানা শুরু হয়—এই আর কী! কখনও ঘূর্ণিঝড়ের মুখ অন্যত্র ফিরিয়ে বাংলাদেশকে বাঁচান তো কখনও পেট মেজে, চা খাইয়ে ক্যান্সার ভালো করেন। কখনও হাজার ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তারও তাঁকে টলাতে পারেন না, কখনও বা তাঁর আদেশে মধ্যাকর্ষণ বল থেমে গিয়ে আপেল শূন্যে ভাসতে থাকে। আবার কখনও দেখা যায় এক ছটাকী প্লেটে দুই লিটার পানি হজম করাতে। ঐ যে, এক বদনায় পুরো আনা সাগর। তেমন আর কী! যে যেখানে যায় সেখানেই দেখে। কখনও মক্কা-মদিনা, কখনও বাগদাদ-আজমির কিংবা কখনও ইউরোপ-আমেরিকা। কোথায় নেই তিনি? একই সময়ে। যার উপর-নিচ, ডান-বাম ঘুচে যায়, তার সবখানে থাকাটা আর এ আশ্চর্যের কী? দরবেশ বজলুল করিম মন্দাকিনী-ই বেশ দারুণ লিখেছেন—
তুর প্যালেস্টাইন, দামেস্ক-মিশরে
মহাসমারোহে মদিনা নগরে
বাগদাদ-আজমিরে পেয়েছি তোমারে
অপার করুণা দান—
কে তুমি হে সখা আড়ালে থাকিয়া
হরিলে আমার প্রাণ...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...