পথে পথে-২
ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি।
অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু—
“বাঁশখালিইইইই, মইশখালি
পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান
গুরগুরাই টানে—
হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।
কর্ণফুলীর মাঝি আঁই
নিয়ুম ভাটি-উজানে,
হন হন যাবি আঁর সাম্পানে
ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।”
মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা হলেও ঢাকার প্রতি তার একটা আলগা টান আছে। ঢাকা নিয়ে নেতিবাচক শুনলে তার ‘বাড়া ভাতে ছাই’ পড়ে। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছে হয়ত! তার আগে তাকে খুশি করে দুলাইন গেয়ে দিলাম—
“ঢাকার পোলা
ঢাকার পোলা,
ঢাকার পোলা—
ভেরি ভেরি স্মার্ট।”
স্মার্ট বলতে বলতে চোখ পড়লো নদীর পানিতে। পানি আর পানি নেই। ডিজেল হয়ে গেছে। এত নোংরা আর দুর্গন্ধ চট্টগ্রামের নালাগুলোও হয় না। দেখে মায়া হলো। বললাম—হায়রে বুড়িগঙ্গা, তুই আসলেই বুড়ি হয়া গেছস। তোর চামড়া ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তোকে দেখে আর কারো কবিত্ব জাগে না। একসময় হয়ত ভরা যুবতী ছিলি। রসে টইটম্বুর ছিল তোর দুকূল। ক্লান্ত পথিক এসে তোর জলে মাখামাখি করে সকল ক্লান্তি বিসর্জন দিত। জলপানে তৃষ্ণা মেটাতো হাজারো বেদুইন। রূপ দেখে এ বাংলার কবিরা তোর প্রেমে হাবুডুবু খেতো নিশ্চয়। তোর পাড়ে বসেই লিখে ফেলত কত-শত লাইন। তাই না?
হ্যাঁ-রে, সাহিত্যের মাঠটাও তোর মতো পচে গেছে। তোর থেকে যেরূপ দুর্গন্ধ ছড়ায়, কবিতা থেকেও তেমনটা ছড়ায় এখন। এখন আর সাহিত্য লাগে না, পর্ণস্টাররাও কিছু একটা লিখে মেলায় তোলে দিতে পারে। ঐ কাকগুলিকে দেখ। তোর পাড়ে পড়ে থাকা আবর্জনার জন্য লাইন ধরেছে। একটার উপর অন্যটা হুড়মুড়িয়ে পড়ছে। ‘কাকে মেরে কে খায়’ অবস্থা। বইমেলার অবস্থাও এখন ঐরকম। অখাদ্য গেলার জন্য সেখানে হুড়োহুড়ি, লম্বা লাইন। মেলার ধরাবাঁধা এখন কেবলই ধর্মকেন্দ্রিক। তুই বুড়িগঙ্গা, তুই স্রোতস্বিনী। তুই যত নোংরাই হোস না কেন, তোর জন্য সাত খুন মাফ। ধর্ম—সে যত উৎকৃষ্ট কথা বলুক, যত ভালো সাহিত্যই হোক—তোর পচা জল পানকারীদের কাছে তা অপাঙ্ক্তেয়।
হক কথা তিতা। বুড়িগঙ্গারও সহ্য হলো না। ঢেউয়ের তোড়জোড় বেড়ে গেলো।
“দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?”
সম্ভবত আমাকে একবার নোংরা পানিতে চুবিয়ে তার মনের খায়েস মেটাতে চায়। তাকে বললাম, “দেখ ভাই, রাগ হইস না, কথা শোন। পচন কি আর তোর একার গায়ে ধরেছে? আমরা মানুষরাও বা কতটা পরিশুদ্ধ আছি? তোর অস্থিমজ্জা যেমন পচেগলে গেছে, মানুষের শিরা-উপশিরাও তেমর গলেপচে ছারখার। এ বিশাল ঢাকার নানাপদের আবর্জনায় যেরূপ তোকে নোংরা বানিয়েছে, গিবত, চোখলখুরি, হিংসা, ফ্যাসাদ, সুদ, ঘুষ, হারাম ইত্যাদি আবর্জনাগুলোও মানুষের ভেতরটা নোংরামিতে ভরিয়ে দিয়েছে। দুর্গন্ধ কি তোর একার ছড়ায়, আমাদের মানবসমাজে ছড়ায় না? পার্থক্য এই—তোরটা স্পষ্ট দেখা যায়; মানুষেরটা যায় না। সে হিসেবে তুই মানুষ থেকে ভালো। কারণ, তোকে দেখে সতর্ক হওয়ার সুযোগ আছে, মানুষকে দেখে তাও নেই। কে যেন বলেছিল—অমানুষগুলো দেখতে অবিকল মানুষের মতো।”
আবু সাইদের ডাকে সংজ্ঞা ফিরল।
“কী ভাই, নদীর পানিতে একদৃষ্টে কী দেখেন? কবিতা-টবিতা লিখতেছেননি মনে মনে?”
—আরে নাহ। কবিতা কি চাইলেই লেখা যায় নাকি?
—যাবে না কেন? নজরুল তো চায়লেই লিখতে পারতেন।
—তা বটে। নজরুল চায়লেই পারতেন। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বসেই ‘সিন্ধু-হিল্লোল’ লিখে ফেলেছিলেন। আমি তো আর নজরুল না, সৈয়দুল। নজরুল আর সৈয়দুলে এখানেই ফারাক।
আমাদের কথায় মাঝি কাকা হঠাৎ বামহাত ঢুকালো। তার কথা হচ্ছে রবিন্দ্রনাথ নজরুলের লেখা চুরি না-করলে নজরুলের লেখা আরও অনেক বেশি থাকতো। তাকে বললাম, “একদম ঠিক বলেছেন। আপনি অনেক জ্ঞানী লোক। আমি এ-কথা অনেকের কাছে শুনেছি।” আমার সায় পেয়ে তার উৎসাহ কয়েক গুণ বেড়ে গেল। সে তার শিক্ষা-দীক্ষা জাহির করার অবকাশ পেল। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো, “আসলে মামা বেশি লেহাপড়া করার সুযোগ পাইনাই। আমগো সময়ে আমার মতো পড়ালেহা কেউ পারতো না।” তাকে আবার বললাম, “লেখাপড়া না-করেও এতকিছু জানেন, করলে যে কী অবস্থা হইত, আল্লাজানে।“ এদিকে হাসতে হাসতে মুকিম আর আবু সাইদের অবস্থা খারাপ। কোনোরকমে মুখটা চেপে রেখেছে। তাদের বললাম, দেখ ভাই, একজন মাঝির মাঝে কত প্রতিভা। জানি, এ বাংলার পথে-ঘাটে, অন্দরে-বন্দরে এমন আরও বহুত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। ছবি তোল, ছবি তোল। কাকার সাথে এ স্মরণীয় মুহূর্তটা যেন ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়ে না-যায়...
ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি।
অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু—
“বাঁশখালিইইইই, মইশখালি
পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান
গুরগুরাই টানে—
হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।
কর্ণফুলীর মাঝি আঁই
নিয়ুম ভাটি-উজানে,
হন হন যাবি আঁর সাম্পানে
ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।”
মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা হলেও ঢাকার প্রতি তার একটা আলগা টান আছে। ঢাকা নিয়ে নেতিবাচক শুনলে তার ‘বাড়া ভাতে ছাই’ পড়ে। সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছে হয়ত! তার আগে তাকে খুশি করে দুলাইন গেয়ে দিলাম—
“ঢাকার পোলা
ঢাকার পোলা,
ঢাকার পোলা—
ভেরি ভেরি স্মার্ট।”
স্মার্ট বলতে বলতে চোখ পড়লো নদীর পানিতে। পানি আর পানি নেই। ডিজেল হয়ে গেছে। এত নোংরা আর দুর্গন্ধ চট্টগ্রামের নালাগুলোও হয় না। দেখে মায়া হলো। বললাম—হায়রে বুড়িগঙ্গা, তুই আসলেই বুড়ি হয়া গেছস। তোর চামড়া ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তোকে দেখে আর কারো কবিত্ব জাগে না। একসময় হয়ত ভরা যুবতী ছিলি। রসে টইটম্বুর ছিল তোর দুকূল। ক্লান্ত পথিক এসে তোর জলে মাখামাখি করে সকল ক্লান্তি বিসর্জন দিত। জলপানে তৃষ্ণা মেটাতো হাজারো বেদুইন। রূপ দেখে এ বাংলার কবিরা তোর প্রেমে হাবুডুবু খেতো নিশ্চয়। তোর পাড়ে বসেই লিখে ফেলত কত-শত লাইন। তাই না?
হ্যাঁ-রে, সাহিত্যের মাঠটাও তোর মতো পচে গেছে। তোর থেকে যেরূপ দুর্গন্ধ ছড়ায়, কবিতা থেকেও তেমনটা ছড়ায় এখন। এখন আর সাহিত্য লাগে না, পর্ণস্টাররাও কিছু একটা লিখে মেলায় তোলে দিতে পারে। ঐ কাকগুলিকে দেখ। তোর পাড়ে পড়ে থাকা আবর্জনার জন্য লাইন ধরেছে। একটার উপর অন্যটা হুড়মুড়িয়ে পড়ছে। ‘কাকে মেরে কে খায়’ অবস্থা। বইমেলার অবস্থাও এখন ঐরকম। অখাদ্য গেলার জন্য সেখানে হুড়োহুড়ি, লম্বা লাইন। মেলার ধরাবাঁধা এখন কেবলই ধর্মকেন্দ্রিক। তুই বুড়িগঙ্গা, তুই স্রোতস্বিনী। তুই যত নোংরাই হোস না কেন, তোর জন্য সাত খুন মাফ। ধর্ম—সে যত উৎকৃষ্ট কথা বলুক, যত ভালো সাহিত্যই হোক—তোর পচা জল পানকারীদের কাছে তা অপাঙ্ক্তেয়।
হক কথা তিতা। বুড়িগঙ্গারও সহ্য হলো না। ঢেউয়ের তোড়জোড় বেড়ে গেলো।
“দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?”
সম্ভবত আমাকে একবার নোংরা পানিতে চুবিয়ে তার মনের খায়েস মেটাতে চায়। তাকে বললাম, “দেখ ভাই, রাগ হইস না, কথা শোন। পচন কি আর তোর একার গায়ে ধরেছে? আমরা মানুষরাও বা কতটা পরিশুদ্ধ আছি? তোর অস্থিমজ্জা যেমন পচেগলে গেছে, মানুষের শিরা-উপশিরাও তেমর গলেপচে ছারখার। এ বিশাল ঢাকার নানাপদের আবর্জনায় যেরূপ তোকে নোংরা বানিয়েছে, গিবত, চোখলখুরি, হিংসা, ফ্যাসাদ, সুদ, ঘুষ, হারাম ইত্যাদি আবর্জনাগুলোও মানুষের ভেতরটা নোংরামিতে ভরিয়ে দিয়েছে। দুর্গন্ধ কি তোর একার ছড়ায়, আমাদের মানবসমাজে ছড়ায় না? পার্থক্য এই—তোরটা স্পষ্ট দেখা যায়; মানুষেরটা যায় না। সে হিসেবে তুই মানুষ থেকে ভালো। কারণ, তোকে দেখে সতর্ক হওয়ার সুযোগ আছে, মানুষকে দেখে তাও নেই। কে যেন বলেছিল—অমানুষগুলো দেখতে অবিকল মানুষের মতো।”
আবু সাইদের ডাকে সংজ্ঞা ফিরল।
“কী ভাই, নদীর পানিতে একদৃষ্টে কী দেখেন? কবিতা-টবিতা লিখতেছেননি মনে মনে?”
—আরে নাহ। কবিতা কি চাইলেই লেখা যায় নাকি?
—যাবে না কেন? নজরুল তো চায়লেই লিখতে পারতেন।
—তা বটে। নজরুল চায়লেই পারতেন। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে বসেই ‘সিন্ধু-হিল্লোল’ লিখে ফেলেছিলেন। আমি তো আর নজরুল না, সৈয়দুল। নজরুল আর সৈয়দুলে এখানেই ফারাক।
আমাদের কথায় মাঝি কাকা হঠাৎ বামহাত ঢুকালো। তার কথা হচ্ছে রবিন্দ্রনাথ নজরুলের লেখা চুরি না-করলে নজরুলের লেখা আরও অনেক বেশি থাকতো। তাকে বললাম, “একদম ঠিক বলেছেন। আপনি অনেক জ্ঞানী লোক। আমি এ-কথা অনেকের কাছে শুনেছি।” আমার সায় পেয়ে তার উৎসাহ কয়েক গুণ বেড়ে গেল। সে তার শিক্ষা-দীক্ষা জাহির করার অবকাশ পেল। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললো, “আসলে মামা বেশি লেহাপড়া করার সুযোগ পাইনাই। আমগো সময়ে আমার মতো পড়ালেহা কেউ পারতো না।” তাকে আবার বললাম, “লেখাপড়া না-করেও এতকিছু জানেন, করলে যে কী অবস্থা হইত, আল্লাজানে।“ এদিকে হাসতে হাসতে মুকিম আর আবু সাইদের অবস্থা খারাপ। কোনোরকমে মুখটা চেপে রেখেছে। তাদের বললাম, দেখ ভাই, একজন মাঝির মাঝে কত প্রতিভা। জানি, এ বাংলার পথে-ঘাটে, অন্দরে-বন্দরে এমন আরও বহুত প্রতিভা লুকিয়ে আছে। ছবি তোল, ছবি তোল। কাকার সাথে এ স্মরণীয় মুহূর্তটা যেন ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়ে না-যায়...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন