সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রোযা না রাখার পরিণতি

রোযা না রাখার পরিণতি

-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক


‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমনি ভাবে করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া হাসিল করতে পারো’ (বাকারা-১৮৩)। রমজানের রোযা রাখা ফরজ। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয়। নামাযের পরেই এর অবস্থান। রাখতেই হবে। নির্দিষ্ট ওজর ব্যাতীত অজুহাত দেখানোর সুযোগ নেই। ইচ্ছা করে ফরজ আদায় না করা কবিরা গুনাহ। ইসলামী শরিয়ত মতে ‘তওবা’ ছাড়া আল্লাহ পাকের দরবারে এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই। অনেকেই ইচ্ছা করে রোযা রাখে না। যারা মাহে রমজান পাওয়ার পরও রোযা রাখে না এবং এই মাসকে সম্মান করে না, তাদের মত দুর্ভাগা আর কে আছে? কেউ নাই।


রোযা কী?

রোযা ফার্সি ভাষার শব্দ। যেমনি  ভাবে নামাযের আরবি ‘সালাত’, তেমনি ভাবে রোযার আরবি ‘সওম’। অর্থ ‘বিরত থাকা’। শরীয়তের পরিভাষায় ‘সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও যাবতীয় অশ্লিল ও মন্দকাজ থেকে বিরত থাকাই রোযা’।


রোযা না রাখলে কী হয়? 

শরীরে রোগ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। না করলে ক্ষতি। এই সহজ থিউরি সকলের জানা। তেমনি ভাবে মানুষের কলবেও রোগ হয়। আর এর মিডিসিন হলো খোদার যিকির। রোযার হচ্ছে সে যিকির আদায়ের অন্যতম মাধ্যম। কেননা নামাযের পরেই রোযার স্থান। অতএব, কলবের মরিচীকা দূর করতে রোযা রাখতেই হবে। না রাখলে ক্ষতির সম্মুক্ষীন হওয়া ছাড়া উপায় নাই। এসব কেবল সাধারণ থিউরি, চলুন দেখে আসি রাসুলুল্লাহর হাদীসে পাকে কী লেখা আছে?


★ সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (দ.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের একটি রোযা শরিয়তের অনুমতি ও রোগাক্রান্ত হওয়া ছাড়া ভেঙ্গেছে, সে সারা জীবন রোযা রাখলেও সেটার কাযা আদায় হবে না। (সহিহ বুখারী, ১ম খণ্ড, হাদীস-১৯৩৪) কী বুঝলেন? আপনার পুরো জিন্দেগীর রোযা মিলেও রমজানের একটি রেযার সমপরিমাণ হবে না, অসম্ভব। হাদিসের ভাষ্যে এটাই প্রমাণ করে। যদিও শরীয়তে এক রোযার বদলে ষাটটি কাযা রোজার হুকুম দিয়েছে, তবুও তা ঐ এক রোযা সিকিভাগের কিনারায় পৌঁছুবে না। আর ঐ ষাটরোজা হলো খোদার কাছে ক্ষমা পাবার বাহানা মাত্র। সওয়াবে ক্ষেত্রে উভয়ের ব্যবধান যোজন-যোজন। অথচ আমরা সে রোযার ব্যাপারে কতই না উদাসীন!


★একই রাবী থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে পাক পড়ুন। তিনি বলেন, রাসুলে আকরাম (দ.) ইরশাদ করেছেন, ঐ ব্যক্তির নাক ধূলিমলিন হোক, যার নিকট আমার নাম নেওয়া হয়েছে কিন্তু সে আমার উপর দরুদ পড়েনি, আর ঐ ব্যক্তির নাকও ধূলিমলিন হোক, যে রমজান মাস পেয়েছে কিন্তু তার মাগফিরাত হওয়ার আগেই সেটা তার কাছ থেকে অতিবাহিত হয়ে গেছে। (মুসনাদে আহমদ, ৩য় খণ্ড, হাদীস-৭৪৫৫) উল্লেখ্য যে, আরবি ভাষায় ‘নাক ধূলিমলিন হোক’ কথাটি অভিশাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যে ব্যক্তি রোযা রাখে না, সে কতই না হতভাগা, তাকে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ ভৎর্সনা করছেন। বদদোয়া দিচ্ছেন। আর যাকে আল্লাহর রাসূল অভিশাপ প্রদান করেন, তার কি মুক্তির উপায় আছে?


★প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (দ.) এর ফরমান, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়েছে আর তাতে রোযা রাখলো না, সে ব্যক্তি হতভাগা। যে ব্যক্তি আপন পিতামাতাকে কিংবা উভয়ের যে কোনো একজনকে পেয়েছে কিন্তু তাঁর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেনি, সেও হতভাগা। আর যার নিকট আমার নাম উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু সে আমার উপর দরুদ শরীফ পাঠ করেনি, সেও হতভাগা। (মাজমাউয যাওয়ায়িদ, ৩য় খণ্ড, ৩৪০ পৃষ্ঠা) এ হাদিসেও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যে রমজান মাস পেয়েও রোযা রাখলো না, তার মত দুর্ভাগা আর কেউ নেই। অতএব, দুর্ভাগাদের দলে না ভিড়ে, রোযা রেখে সৌভাগ্যশালীদের দলে ভিড়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।


★অনেকে সাহরি খেয়ে রোযা রাখে। আবার মধ্যখানে ভেঙ্গেও ফেলে। তাই রোযা রেখে ওজর ব্যাতীত মধ্যখানে তথা ইফতারের পূর্বে ভেঙ্গে ফেলার পরিনাম কী হতে পারে? সে ব্যপারেও একটু জানা দরকার। প্রখ্যাত সাহাবি হযরত আবু উমামা বাখেলী (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন স্বপ্নে দুজন লোক আমার নিকট আসলো। আর আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ের উপর নিয়ে গেলো। আমি যখন পাহাড়ের মাঝখানে পৌঁছুলাম, তখন ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এসব কিসের আওয়াজ? তখন আমাকে বলা হলো, এটা জাহান্নামীদের আওয়াজ। তারপর আমাকে আরো সামনে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমি এমন কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদেরকে তাদের পায়ের রগ দ্বারা গোড়ালীতে বেঁধে উপুড় করে ঝুলানো হয়েছে। আর তাদের চিবুকগুলো ছিড়ে ফেলা হয়েছে। ফলে সেগুলো থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা? উত্তর আসলো, এর ঐসব লোক, যারা রোযা ভঙ্গ করতো এরই পূর্বে যখন রোযার ইফতার করা হালাল।অর্থাৎ- ইফতারের পূর্বে রোযা ভেঙ্গে ফেলতো। (সহিহ ইবনে হাব্বান, ৯ম খণ্ড)


উপরের আলোচনা থেকে এ কথা সুস্পষ্ট যে, রোযা পালণের মাধ্যমে যেমনি ভাবে অগুণিত কল্যাণ রয়েছে, তেমনি ভাবে রোযা না রাখলেও তার জন্য রয়েছে অপরিসীম শাস্তি। অতএব, আমাদের করণীয় হলো যথাযত ভাবে মাহে রমজানের রোযা পালণ করা। প্রিয় মুসলিম ভাই-বোনেরা! আসুন আমরা প্রত্যেকে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিব (দ.) এর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে পবিত্র মাহে রমজানে সওম তথা রোযা পালন করি। অন্যদেরকেও রোযা পালণে উৎসাহিত করি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...