সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঐতিহাসিক খায়বার ও এক বীরের বীরগাথা


ঐতিহাসিক খায়বার ও এক বীরের বীরগাথা

-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক


সপ্তম হিজরি। প্রায় পনেরো’শ সঙ্গী নিয়ে নবীরাজের যাত্রা খায়বার অভিমূখে। লক্ষ্য, মক্কার মুশরিকদের মুসলিম বিরোধী ইন্দনদাতা ও সাহায্যকারী কুখ্যাত ইহুদিগোত্রের দশহাত নেয়া। ততদিনে ইসলাম রবি আলো ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। আগের মত নিরস্ত্র আর নির্জন নেই ইসলাম ভাণ্ডার। সাম্প্রদায়িক ও অশুভ শক্তির বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে হাতুড়ি-শাবালও মোটামোটি যোগাড় আছে। সবচে বড় হাতিয়ার ‘তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ’ ও ‘হুব্বে রাসূল (দ.)’ তো আছেই। সাথে এবার যুক্ত হয়েছে দুইশ অশ্বারোহী। মদিনা থেকে খায়বারের দূরত্ব আশি মাইল। দু’শ অশ্বারোহী ব্যাতীত বাকিরা পতাদিক। পদাতিক হলো যারা পায়ে হেঁটে চলে। একটু ভাবুন, আজ থেকে চৌদ্দ’শ বছর আগের কথা! কত রুক্ষ আর কঠিন ছিলো তখনকার পথঘাট। ঠিক সে সময় এদের কীসে দমাতে পেরেছিল? না সূর্যের প্রখরতা, না গরমের তীব্রতা! না পাথরের শক্ত গড়ন, না পথের দূরত্ব! ছিলো কী? কোন শক্তি এদের ঠিক অতটা উদ্যোমী, অতটা ত্যাগী আর অতটা ধৈর্যশীল বানিয়েছিলেন? ভাবুন, ভাবতে থাকুন......


চলতে চলতে একসময় গন্তব্যে পৌঁছে যায় মুসলিম বাহিণী। ঠিক যেখানে খায়বার অবস্থিত। হ্যাঁ, এরা মুসলিম ছিলো, আমরাও তাই। তবে ফারাক আছে। বিশাল এক ফারাক। মতাদর্শ কিংবা মুলনীতিতে নয়, পার্থক্য কেবল সৌর্যবীর্যে। শক্তিতে নয়, মনোবলে। জনসংখ্যায় নয়, ইত্তেহাদে। হাতিয়ারে নয়, বীরত্বে। তাঁদের ওসব ছিলো, আমাদের নেই। অন্তত খায়বারে দশহাজারের বিপরিতে পনেরো’শর বিজয় আর প্রতিপক্ষের সূচনীয় পরাজয় সেটাই প্রমাণ করে।


সে যাই হোক, রাসুলের সেনাবাহিণীর আকস্মাৎ আগমণ দেখে দুষ্টু খায়বারবাসি দিকভ্রান্ত হয়ে যায়। ছুটতে থাকে দিগ্বিদিক। কেউ কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে আসলেও অনেকে করছে আত্মসমর্পন। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পুরো খায়বার। এভাবে চলে গেলো আটারোদিন। ইতোমধ্যে জয় হয়ে গেছে সব দূর্গ। কেবল কামুস ছাড়া। সবচেয়ে শক্তিশালী এ দূর্গে ইতোমধ্যে আক্রমণ করে এসেছেন হিজরতসঙ্গী আবু বকর ও তাবুকে অর্ধসম্পদ দানকারী উমর। সফল হননি। তবে এটাকে ব্যর্থতা বলা যায় না। কেননা এ বিজয়ের বীর হিসেবে ইতোমধ্যে খোদায়ী ডায়রিতে লিখা হয়ে গেছে অন্য একজনের নাম। কে সে? জানা যাবে উনিশতম দিনে।


যুদ্ধের আটারোতম দিনের সমাপ্তি। খায়বারের আকাশ ছেঁয়ে গেছে রাতের অন্ধকারে। সাহাবিরা সব সমবেত। নবীরাজের ঘোষণা- ‘‘আগামীকাল আমি এমন একবীরের হাতে তরবারি তুলে দেবো, যার বিরত্বে স্বয়ং আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল উভয়ে সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। এবং এ প্রতিদানের কারণে সেঁও আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (দ.)’র উপর কৃতজ্ঞ হয়ে যাবে। তাঁর হাত ধরেই খায়বারের চুড়ান্ত বিজয় ঘোষিত হবে।’’


উনিশদিনের সকাল। সূর্যটা আজ বেশ দীপ্ত মনে হচ্ছে। তার কিরণগুলোর তেজ দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি কামুসকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দেবে। সেনাদল প্রস্তুত। সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে। সবার মনে কৌতুহল একটাই- কে হবেন খায়বারজয়ী সে সৌভাগ্যবান, যাঁর ব্যাপারে ভবিষ্যতজান্তা নবী গতকালকেই ঘোষণা দিয়েছেন। সেনারাজ একে একে সবাইকে পরখ করলেন। আলী কই? 


-চোখে ইনফেকশনজনীত সমস্যায় ভুগছেন। ভীষণ জ্বালাপোড়া। তাবুতেই রয়েছেন। -জৈনকের উত্তর।


-যাও, ডেকে আনো। বলো যে আল্লাহর রাসুল ডাকছেন।


তিনি জানতেন, যখন আল্লাহর রাসুল কাউকে ডাকেন, তখন যে কোন অবস্থাতেই সাড়া দিতে হয়। চোখ কসলাতে কসলাতে হুড়মুড়িয়ে চলে এলেন। নবীরাজের সামনে আপন পিতা-মাতাকে কুরবানি দিয়ে স্বসম্মানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। নবীরাজ আলীকে দাওয়া দিলেন। অদ্ভুত দাওয়া! আজকের দিনে কেউ কাউকে দিলে তার ‘ত্রাহী মধুসুদন’ অবস্থা নিশ্চিত। থুথু মোবারক! হুঁ, যে থুথুর পাওয়ারে চোখের ইনফেকশন সাথে সাথে হিমালয় অতিক্রম করে, তা মোবারক না হয়ে পারে না। সব রোগের আজব নিরাময় ছিলো এ থুথু। ঐ যুগে রোগ যেটাই হোক না কেন, নিরাময় একটাই- নবীরাজের থুথু! নবীজির কাঁদে জুলফিকার চমকাচ্ছে। কভার ছিড়ে তার আলোকরশ্মি বিচ্চুরিত হচ্ছে। ইহুদিদের গর্দান কাটার জন্য তার লুলুপদৃষ্টি বুঝি তর সয়ছে না! কাঁদ থেকে হাতে নিলেন। হাত থেকে আলীর হাতে। ‘‘যাও, যতক্ষণ খায়বার পূর্ণবিজয় না হচ্ছে, যুদ্ধ করতে থাকো। তোমাকে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’’


আলী যেন আরো হাজার-লক্ষগুণে বলিয়ান হয়ে উঠলেন। যৌদ্ধাসাজে সজ্জিত। একহাতে জুলফিকার অপরহাতে বর্ম। কামুস সম্মুখে দাঁড়িয়ে। ইহুদিবীর মারহাব এগিয়ে এসে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন-

‘জনে জানে, তরু জানে, জানে এই খায়বার

বিজয়াবদি থামেনি কভু মারহাব-তলোয়ার’


খোদার শের, শেরে খোদার প্রত্যুত্তর-

‘বিরত্ব মোর সিংহতূল্য, মাতা বলেন হায়দার

শত্রুসব ছিন্ন করবে এই আলীর জুলফিকার’

বলতে দেরি এক লাফে মারহাবের মাথা দ্বিখণ্ড হতে দেরি নেই। মাথার মুকুট ছেদ করে জুলফিকার পৌঁছে গেছে দাঁত অবদি। জুলফিকারের কারিশমা ওখান থেকেই শুরু। আর শেষ হয় নি। চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত। খায়বার-বীর একাই উপড়ে ফেললেন কামুসের মুলফটক! যেটাকে তুলতে অন্তত চার-পাঁচজন বীর-ফহলোয়ান লাগবে। ওটাকে ব্রীজ হিসেবে ব্যাবহার করে মুসলিম সেনারা ঢুকে পড়ে কামুসের অন্দরমহলে। দূর্গবাসি আর যায় কোথায়? একে একে উড়ে গেলো বহু ইহুদির মাথা। অবশেষে ইহুদিদের আত্মসমর্পন। অর্থাৎ, আমরা আর যুদ্ধে রাজি না। আপনারা যা বলেন, তাতেই রাজি। যুদ্ধ ফিনিস। ‘সুপার ফিনিসিং’ যাকে বলে। বিজয়ীবীর আলীর ললাটে চমক! এ চমক বেহেশতের পথ দেখিয়ে দেয়। তাঁর আলোতে যে কেউ অবলীলায় বেহেশত পর্যন্ত পাড়ি দিতে পারবে। সেদিন থেকে আলীর নামের পাশে আরো একটি শব্দ যুক্ত হলো। আসাদুল্লাহ! আল্লার সিংহ!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...