নবাবপুরের হালচাল
-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
নবাবপুর কবরস্থান। আমাদের গ্রামের একমাত্র কবরস্থান। নবাবপুর কেবল নামেই নবাব নয়, গ্রামের প্রায় সবকিছুতেই বিশেষ এক নবাবিয়ত আছে। এই যেমন ধরেন- গ্রামের চেয়ারম্যান ‘নবাব বাহাদুর’। গ্রামের প্রধান মসজিদ- ‘মসজিদে নবাবি’। গ্রামে যে একমাত্র হাইস্কুলটা আছে, সেটাও নবাব বাহাদুরের দাদার নামে- ‘নবাব কলিমুল্লাহ হাইস্কুল’। ‘মাদরাসা-এ নববী’ লিখতে গিয়ে প্রায় দশ বছর আগে সেই যে ভুল করে ‘মাদরাসা-এ নবাবী’ লিখে ফেলেছিলেন, তখন থেকেই এই এলাকার দাখিল মাদরাসাটাও এই নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। পরে অবশ্য এলাকার সরদার-মাতবররা মিলে নামটা পাল্টাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বহুবছরের পরিচিত Chittagong কে Chattagram করার মধ্যে তেমন কাবালিয়ত(দুরদর্শিতা) তারা খোঁজে পান নি। পুরো গ্রামজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন মৌসুমী ফলগাছের বাহারি সমাবেশ। ধনে-মানে-সৌন্দর্যে অন্য আটগ্রামের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এ গ্রামের আসল সৌন্দর্য ফোটে উঠে শেষ বিকেলে অর্থাৎ গোধুলীর সময়ে। বধুবেশ ধারণ করে লাল বেনারশি পড়ে রবিবাবু যে অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়, তা এ গ্রামেই সবচেয়ে বেশি ফুটে উঠে। ওসব রুক্ষ-শুষ্ক শহরে এ রূপ উপভোগ করা সম্ভব না। কেননা হাতের চুরি, নাকের ফুল, কানের দুল, গলার চেইন, এসব কেবলই সুন্দরী নারীর শোভা বর্ধন করে। পুরুষের দেহে এগুলো ‘বানরের গলায় মুক্তোর মালা’র মতই। কথায় আছে না, ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃকোড়ে’? এ গ্রামটা যেন তেমনই অপরূপ রূপের রাণী, আর গোধুলীর সুর্যটা তার বিশেষ সময়ের বিশেষ গয়না। এ সময় গ্রামের রাস্তা দিয়ে যদি আপনি কোন একবারের জন্য হেঁটে যান, তো মনে রাখুন- আপনি ঐ রাস্তা দিয়ে বিনাশর্তে প্রতিদিন হাঁটার লোভ সামলাতে পারবেন না। শুধু এসব কেন, এই গ্রামের ছেলে-মেয়ে, আবাল-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে মোল্লা-মুন্সি পর্যন্ত সকলেই নবাবী হালতে চলাফেরা করে। একেকজন মাওলানার গায়ের আলম্পনা দেখলে বাইরে থেকে আসা যে কেউ রাজপুত্র ভাবতে ভুল করবে না। ছেলে-মেয়েদের নবাবগীরির বর্ণনা আর কি দেব? চুল রাখে বিলাতি স্টাইলে। পোশাক-আশাক পশ্চিমারাষ্ট্রিয় না হলে চলেই না। আর ঘরের বউ-ঝি? তারা হলো সব নবাবের বড় নবাব। ইয়ে মানে, নবাবা অথবা নবাবী ধরতে পারেন। একে তো সারাদিন ভারতীয় সিরিয়াল থেকে মিনিটপাঁচেকের জন্যেও উঠানো যাবে না, তার উপরে কেউ যদি এদের রিমোটকন্ট্রোলে ভুলেও হাতচালান করে বসে, সেদিন আর পরিবারের কারো কপালে আহার জুটার সম্ভাবনা পৌষ মাসের বৃষ্টির মত। অপরাধির বেশে নবাবজাদারা যতই তৈলাপাত-মলমপাত করুক না কেন, এদের গণ্ডদেশের(গালের) বিশেষ ফুলারোগ সারাতে তাদের অন্তত তিনদিন সময় লেগে যাবে। আর সিরিয়ালি ভাষায় একেই বলে পাক্কা নবাবী কিংবা সর্বোৎকৃষ্ট নবাবিয়্যত। সবমিলিয়ে বলা চলে- এ গ্রাম কান-ফুল ব্যাথিত ‘কর্ণফুলি’ যেমন নয়, তেমনি খোলা আকাশের বুকে উন্মোক্ত থাকা সত্ত্বেও ‘ঢাকা’ নয়। আক্ষরিক অর্থেই নবাবিয়তপূর্ণ নবাবপুর। সে যা’ই হোক, বলছিলাম গোরোস্তানের কথা। গ্রামের অন্য সবকিছুর মত এই কবরস্থানেরও একটা নবাব নবাব ভাব আছে। শতবছরের পুরোনো এ কবরস্থান লম্বায় প্রায় আধকিলোমিটারের কম হবে না। চওড়ায় তা এক কিলোমিটারের তিন ভাগের একভাগ। সেদিন গোরোস্তানের পাশদিয়ে হাঁটছিলাম। রাত তখন নটা কি সাড়ে নয়টা বাজে............
চলবে..........
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন