নবাবপুরের হালচাল(৪)
ওদিক থেকে কে যেন আসছে। আবছা আলোয় আপাতত ভুতের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে না। সামনে অগ্রসর হতে লাগলাম। দেখতে দেখতে ভুতটা ক্রমেই মানুষত্ব লাভ করতে লাগলো। প্রায় কাছাকাছি। মাঝে কেবল দুহাতের মত ফাঁকা। এবার দুজন একই পথে একই রাস্তায় হাঁটছি। বাহ, চমৎকার! দুরাস্তার দু পথিক একি পথে হাঁটছে। মানুষগুলোও যদি এভাবে বহুপথ ভুলে একপথের পথিক হতো! সাম্যের পথের, ভালোবাসার পথের। তবে দুনিয়াটাও হয়তো স্বর্গ হয়ে উঠতো।
‘‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেতেই সুরাসুর’’ এখন কেবলই পাঠ্যবইয়ের ভাব সম্প্রসারণে আবদ্ধ। মানুষের মাঝে সে ভাবের বিনিময় ক্রমেই সংকোচিত হয়ে আসছে। পরীক্ষার খাতায় এটা যত না সম্প্রসার হয়, বাস্তবতায় তারচে ঢের সংকোচন হচ্ছে। পৃথিবী থেকে যখন সম্প্রীতি-সৌহার্দ উঠে যাচ্ছে, তখন পৃথিবীই বা কোন দুঃখে স্বর্গ হতে যাবে। এটা এখন কেবলই পরিপূর্ণ নরকে রূপ নিয়েছে। চাঁদের আলোয় কারো চেহেরা ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। লোকটা আমার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। মনে হয় আমাকে চেনে। আমারও কেমন চেনা চেনা লাগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম পুরোটাই ভুত। পরে ভাবলাম মানুষ। এখন দেখি অর্ধেক ভুত অর্ধেক মানুষ! আবারো ধাঁধা।
হঠাৎ দেখি ভুতটা আমাকে ঝাপটে ধরলো। জব্বর বলির অপজিশনের চেয়ে শক্ত করে। আমি অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। স্তম্ভিত। পরক্ষণেই সম্ভিত ফিরে পেলাম আরো ধাঁধাময় শব্দে।
-দোস্ত, তুই? (ভুত সাহেব)
-আরে তুই? (আমি)
-হাঁ, আমি। আমি রেযা। চিনতে পেরেছিস তাহলে? (রেযা। পুরো নাম রেযাউল করিম বাহাদুর। সবাই রেযা বলেই ডাকে। নবাব বাহাদুরের ছেলে। আমার বাল্যবন্ধু। খেলার সাথী। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত দুজনে একসাথেই বড় হয়েছিলাম। তারপর ভাগ্যক্রমে আমি পাবলিকে চান্স পেয়ে শহরে চলে যাই, আর সে ডিগ্রীতে এডমিশন নিয়ে গ্রামেই থেকে গেলো। অবশ্য এটা পুরোটাই তার ইচ্ছায়। তাকে আরর তার বাবার পড়ানোর মত’ই ছিলো না। তার বাবা বলে, তাকে দিয়ে নাকি কিছুই হবে না। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত কেবল বাপের নাম বেঁচে কিনা পাশ করলো তাই। অবশ্য গ্রাজুয়েশনের তার বিশেষ প্রয়োজন নেই। নবাব পরিবারের ছেলে। বংশ পরম্পরায় যা আছে, তা দিয়ে তার চৌদ্দপুরুষ রাজকীয় হালতেই চলে যেতে পারবে। বঙ্গোপসাগরের পানি কি আর শুকোয়? তাই তার ‘নো টেনশন, ডু ফুর্তি’ স্বভাব। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। এলাকার ছোটভায়েরা উঠতে-বসতে সালাম করে। বিপত্তি সব আমার মত মধ্যবিত্তদের নিয়ে। একেকটা মধ্যবিত্ত পরিবার একেকটা যুদ্ধক্ষেত্র। সব সময় বিশেষ এক আতঙ্কের মাঝে কাটাতে হয়। মাস শেষ হবার আগেই পকেটের টাকাগুলো ‘টাটা বাই বাই’ জানিয়ে দেয়। তারপর খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহার-অনাহারে টিউশনির বেতন দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা। এরপর আবারো পুরান গান শুরু। বহুদিন গ্রামে আসা হয় না। প্রায় বছর খানেক পর হঠাৎ সে আমাকে দেখে চমকে যায়।)
-কি বলিস চিনবো না কেন? তোকে না চেনে উপায় আছে? তবে একটু আগে ভুত ভেবেছিলাম(মনে মনে)। তুই হলি আমার লেংটা কালের বন্ধু। সুখ-দুঃখের সাথী। বৃষ্টির দিনের ছাতা, শীতের রাতের কম্বল। আর গ্রীষ্মেররর.......
-থাম থাম, পাঠক সমাজে নিজের স্বভাব আর আমার লুঙ্গিটা খুলে দিস না। কবিত্ব বহুত জাহির হইছে। এখন বল, কখন এলি? জানালি না কেন?
-সময় পাইনি তো, হুট করে আসতে হলো। মা খুব অসুস্থ। খবর পেয়েই চলে এলাম।
-কি বলিস, আন্টি অসুস্থ? কবে থেকে?
-এই তো, গত দুদিন হলো। এখন কিছুটা ভালোর দিকে। ভাবছি শহরে নিয়ে যাবো কিনা। বাদ দে, তোর খবর কী বল?
-আমার খবর আর কি। এই আছি, আগের মতই।
-তো, এত রাতে এদিকে কোথায় যাচ্ছিলি?
-কেন, তুই জানিস না? আজ তো উরস।
-উরস? কার উরস?
-খাজা বাবার। গত বছর থেকে চালু হইছে। ওই যে, করিম মোল্লা আছে না? ওর বাড়ির পাশেই। মুল আয়োজক সে’ই। তাকে নাকি খাজা বাবা স্বপ্নে দর্শন দিয়ে উরস করার নির্দেশ দিয়েছেন। বড় ভাগ্যবান লোক। তোকে পেয়ে বেশ ভালোই হলো। চল, দুজন একসাথে যাই।
কথা আর বাড়ালাম না। বন্ধুর হাতে হাত রেখে অগ্রসর হতে লাগলাম। হাঁ, এই হাত বন্ধুর হাত। অনেক আবেগের হাত। ভালোবাসার হাত। বিশ্বাস করে এ হাতেই প্রথম হাত রেখেছিলাম। এ হাত বহুবার ধরেছি। শতবার, হাজারবার। কিংবা তার চেয়েও বেশি। তবু প্রতিবারে নতুনত্ব আছে। বিশেষত্ব আছে। আলাদা অনুভূতি জাগে। প্রাণের ডাকে সাড়া দিয়ে যখন দুটি হাত একত্রিত হয়, তখন তাকে যতবারই স্পর্শ করুন না কেন, তৃপ্তি পাবেন। নতুনত্ব পাবেন। বিশেষ অনুভূতি পাবেন। আমিও পাচ্ছি। তাই ধরে রেখেছি। ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। রেযা আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমিও তাকাচ্ছি। হঠাৎ সে গুনগুন করে গায়তে লাগলো-
‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো.............’
চলবে........
-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন