সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বরাত১

পনেরো শাবান। গভীর রাত। আম্মাজান হঠাৎ আঁচ করলেন রাসূলে মকবুল বিছানায় নেই। প্রেমাস্পদ কোথায় গেলেন? উৎকণ্ঠা! অজানা ভয়। চারিদিকে শত্রুর যে অভাব নেই। মাকড়সার জালের মত ঘিরে আছে। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করার সম্ভাবনা। বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। খোঁজতে হবে। সতর্কদৃষ্টে এগিয়ে চললেন। মদিনা মোনাওয়ারার বিখ্যাত কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’। নবীপত্নী নবীর খোশবো শোঁকতে শোঁকতে ওখানে চলে গেলেন। দুনিয়ার বাদশাহ ওখানেই। জিয়ারত করছেন। ‘মরা মানুষের’ জিয়ারত। যারা কবরে শায়িত আছেন। নবীজি যা করেছেন, তা সুন্নাত। উত্তম কাজ। তাতে সওয়াব আছে। তাই আমরাও করি। করতে থাকবো। নবীজির চোখ। জাহের-বাতেন অগোচর নয়। হুয়াল আওয়ালু, ওয়াল আ-খিরু, ওয়াযজ্বা-হিরু, ওয়াল বা-তিন। সবজান্তা। তবু প্রশ্ন- আম্মাজান আয়েশা (রা.) এর প্রতি। সন্দেহ-সংশয় কিছুই না। একটু নাড়িয়ে দেখা। স্বামী-স্ত্রীর মধুর দুষ্টুমিতে এ ধরনের প্রশ্ন নেতিবাচক নয়। মনের আবেগটা মুখ দিয়ে বের করে আনার প্রয়াশে এমন প্রশ্নের উদাহরণ অগুনিত। ‘তুমি কি এই আশঙ্কা করছো যে, আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (দ.) তোমার সাথে অবিচার করবে?’ ‘সিদ্দিকজাদী’ ভড়কে গেলেন না। শান্তসুরে জবাব দিলেন- ‘ভেবেছিলাম আপনি অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে তাশরীফ নিয়েছেন হয়ত!’ আম্মাজান এমনটা ভাববেন না কেন? নবীজি যে সর্বোত্তম হক আদায়কারী। আমি বলছি না। মা আয়েশাও না। জন্মের শত্রু মক্কার কাফের-মুশরিকদের মাধ্যমে স্বীকৃত। হুযুর এবার অমীয় বাণী শোনালেন- ‘শা’বানের পনেরো তারিখের রাত। মহা-মর্যাদাবান। এ রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার আসমানে বিশেষ তাজাল্লী বর্ষণ করেন। শুধু তা নয়। মক্কার বিখ্যাত গোত্র- ‘বনু কালব’ এর ভেড়া-বকরির পশমগুলোর চেয়েও অধিক সংখ্যক পাপীকে তিনি মার্জনা করেন’।


                 ‘ভেড়া-বকরি’। কেবল উদাহরণ মাত্র। লক্ষ্য- আধিক্য বুঝানো। কেন না ঐ গোত্রের ভেড়া-বকরি মক্কার জমিনে সর্বাধিক। বুঝা যায়, ঐ রাতে কতজনের পাপ মাফ হবে, আল্লাহ এবং মদিনা-মুনিবই ভালো জানেন(১)। অন্য হাদীসে তার প্রমাণ মেলে। হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) এর বর্ণনা। রাসূলে আকরাম, সরকারে দো’জাহা (দ.) এঁর ইরশাদ- ‘মধ্যশাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত মাখলুকের প্রতি মনযোগ আরোপ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন’(২)। সমর্থন পাওয়া যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) এর হাদীসেও। রাসূলে দো-জাঁহার ইরশাদ মোবারক- ‘পনেরো শা’বানের রাত্রে(নিসফে মিন শা’বান) মাওলায়ে কায়েনাত তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করে দেন। কেবল দুজন বঞ্চিত। প্রথম জন ‘পরশ্রীকাতর’। অন্যজন ‘বিনা কারণে হত্যাকারী’’(৩)।


                        হাদীসের ভাষায় যেটি ‘নিসফে মিন শা’বান’, কুরআনের ভাষায় সেটি ‘লাইলাতুম-মুবারাকাহ’(৪)। ভারতীয় উপমহাদেশে ‘শবে বরাত’ বা ‘লাইলাতুল বরাত’। ইরান ও আফগানিস্তানে ‘নিম শা'বান’। মালয় ভাষাভাষীগণের কাছে ‘নিসফু শা'বান’। তুর্কিরা বলে ‘বিরাত কান্দিলি’(৫)। আর এক প্রজাতি আছে। সবার পরিচিত। গিরগিটি সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ট মিত্র। ঘন-ঘন রঙ পাল্টায়। কখনো ‘লা-মাযহাবি’, ‘কখনো সালাফি’, কখনো ‘আহলে হাদীস’। এদের সজাতি ‘শেয়াল মার্কা’ কিছু ভাই-ব্রেদারও আছে। তালে তাল মিলায়-‘আক্কা হুয়া’। একবার শুনলেই হলো। একসুরে সাড়া বন তোলপাড় করে ছাড়ে। এদের ভাষায় ‘বেদাত’। অন্য কোন কারণ নয়। কুরআন-হাদীসের অসমর্থন আছে তাও নয়। এমনকি ‘সহীহ আলবানি নামা’তেও বরাত সম্পর্কিত হাদীস বর্ণিত আছে। তবুও ‘ডাক্তার সাহেব’ আর ‘শায়েখ সাহেব’ বেদাত বলেছেন বলেই বেদাত। শায়েখের কথায় এরা যেমনিভাবে গাভীর মুত্র পান করতে প্রস্তুত, তেমনিভাবে বরাতকেও বেদাত বলে মানবসমাজকে খোদার রিয়াজত থেকে দূরে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। খোদার সৃষ্টিতে আজিব চিজ এরা। ‘খোদা’ শব্দটি কু্রআন-হাদীসে না থাকা সত্ত্বেও খোদাকে খোদা বলতে দ্বিমত করে না, অথচ ‘শবে বরাত’ শব্দটি কুরআন-হাদিসে নেই বলে সরাসরি ‘বেদাত’ তকমা লাগিয়ে দেয়। এরা ‘নামায’ এর বদলে ‘সালাত’ খোঁজে পায়, ‘রোযা’র বদলে ‘সওম’ খোঁজে নেয়, মাগার ‘শবে বরাত’ এর বদলে ‘লাইলাতুম-মুবারাকাহ’ কিংবা ‘নিসফে মিন শা’বান’ খোঁজে না। খোঁজবে কেন? শায়েখ যে বলে দিয়েছেন, ‘এটি বেদাত’। অতএব, এদের যতই কুরআন-হাদীস প্রদর্শন করুন না কেন, ছুম্মুন ভুকমুন উমইউন ফাহুম গা’ফিলুন।


                 আপত্তি করতে গিয়ে বারবার বিপত্তিতে পড়ার পরেও এদের আপত্তির শেষ নেই। বরাত না হয় মানলাম, ইবাদত করতে হবে কেন? হালুয়া-রুটি কোথায় আছে? -মিয়া ভাই, ঐ রাতে ইবাদত করা নিষেধ আছে কোথায়? নাই? তবে ইবাদতে বাধা কোথায়? যা নিষিদ্ধ নয়, তা’ই তো সিদ্ধ। নয় কী? আল্লাহ তায়ালা জীন-ইনসান তো তাঁরই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন, নাকি? তবে রাতজুড়ে করুক না ইবাদত। সারাবছর করে না। বরাতের উচিলায় হলেও অন্তত একটা রাত মাওলার সান্যিধ্যে কাটাক। ওরা কাঁদছে তাতে আপনার কেন ফাটছে জনাব? গভীর রাতে মাওলার প্রেমে সিক্ত আঁখি দুটিই তো মাওলার নিকট সবচে প্রিয়। ঐ প্রিয় আঁখি দুটিতে বেদাত নামক গরমজল ছিঁটাচ্ছেন কোন আস্পর্ধায়? ইবাদতে আপনার অনিচ্ছা-অনিহা, তাই বলে খোদার দরবার থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনার লাইসেন্স আপনাকে কে দিলো? হালাল খাবার হালুয়া-রুটিতেও আপত্তি? শোনে কোলের শিশুও হেসে উঠার কথা। বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে খায়-এতেই সমস্যা। তবে ঈদুল ফিতরে সেমাই-নুডুস-পলান্ন ইত্যাদি সম্পর্কে ফতোয়া দিলেন না যে? প্রথম বৈশাখের পান্তা-ইলিশে? ওখানেও ফতুয়া নেই? তবে বরাতের হালুয়া-রুটিতে কেন? ও হাঁ, শায়েখ বলেছেন তাই? আমের সিজনে আম, জামের সিজনে জাম, লিচুর সিজনে লিচু খাওয়াতে যদি দোষ না থাকে, তবে বরাত নামক ইবাদতের সিজনে হালওয়া-রুটিতে এত এলার্জি কেন? আপনি না খান, সমস্যা নাই। হায়াত-মউত-রিযিক আল্লাহর হাতে। আপনার রিযিকে নাই, আপনি পেলেন না, খেলেন না। তাই বলে বিড়ালের তরিকায় সিকা পর্যন্ত পৌঁছুতে না পারায় হারাম ঘোষণা দেবেন? কুরআনের বাণী দিয়েই ইতি টানি- ‘তোমাদের মুখে যা আসে তাই বলে দিও না- এটা হালাল ওটা হারাম। এতে আল্লাহর নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা চালানো হবে। আর যারাই আল্লাহর নামে এ ধরণের মিথ্যা কথা প্রচার করে, তারা কখনই কল্যাণ বা সাফল্য লাভ করতে পারে না(৬)। 


-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক


তথ্যসূত্র-

(১) তিরমিযী শরীফে, ইমাম ইবনে মাজাহ তাঁর সুনানে, ইমাম বায়হাকী তাঁর শুয়াবুল ঈমানে, ইমাম ইবনে আবী শাইবাহ তাঁর মুসান্নাফে, ইমাম বগবী তাঁর শরহেস সুন্নায়, ইবনে আহমদ তাঁর মুসনাদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

(২) সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৫৬৬৫,

(৩) মুসনাদে আহমদ-৬/১৯৭, হাদীস-৬৬৪২,

(৪)  তাফসীরে কবীর, তাফসীরে রুহুল মাআনী, তাফসীরে রুহুল বায়ান, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে তবরী, তাফসীরে বগবী, তাফসীরে খাযেন, তাফসীরে ইবনে কাসির ইত্যাদি।

(৫) উইকিপিডিয়া।

(৬) সূরা নাহলঃ ১১৬

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...