মৃত্যুটা আসলেই একটা ধাঁধা। দেখুন না, বেঁচে থাকা সম্ভব না জেনেও বেঁচে থাকার কত আয়োজন। অথচ না চাইতেই যে মরতে হবে, তার জন্য মানুষের আয়োজন অতি সামান্য। কেমন বেখাপ্পা বেখাপ্পা লাগে না? আচ্ছা, মানুষের কি মরে যাওয়া উচিৎ, নাকি বেঁচে থাকা? হাবিল-কেনান-এজিদ-জাফরদের স্মরণ করলে মনে হয় মরে যাক। আবার কাবিল থেকে শুরু করে মহামানবদের স্মরণ এলে মনে হয় জনম জনম মানুষদের বেঁচে থাকা উচিৎ। কিছু মানুষ অদ্ভূতভাবে বেঁচে থেকে মরে যায়। আবার কেউ কেউ মরেও বেঁচে থাকে হাজার বছর ধরে। যার দুনিয়াতে কেউ নেই, অথবা যে জন্মান্ধ। কিংবা আজন্ম যে মূক(বোবা), সে কি আসলেই বেঁচে থাকার কোন মানে খোঁজে পায়? আবার দুঃখু মিয়ারা দেখি আজীবন দুঃখ-কষ্ট সয়ে সয়ে মরেও আজ অবদি অবলিলায় বেঁচে আছে। ধাঁধাময় দ্যোতনা। বহুরূপি ইঙ্গিত।
এসব ভাবতে ভাবতে মরাবাড়ি(কবরস্থান) দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথ প্রায় অর্ধেকটা পেছন ফেলে এসেছি। চাঁদটাও দেখি আমার সাথে সাথে আসছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ওর যৌবনলীলাও বেড়ে চলেছে। ছোট বেলায় এটা নিয়ে বন্ধুদের সাথে বেশ ঝগড়া বাঁধাতাম। সবার দাবি থাকতো চাঁদটা তার বরাবর। বড় হয়ে বুঝলাম আসলে আমরা প্রত্যেকেই চাঁদ বরাবর। ভালোই হলো। যেহেতু সঙ্গি কেউ নেই, তাই এই ভেবে ভালো লাগছে যে, অন্তত মাহতাববাবু হলেও এই সঙ্গিহীন মানুষটাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই এই জ্যোৎস্না আমার খুব প্রিয়। প্রায় জ্যোৎস্নারাতেই এই রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটতাম। তাই বহু স্মৃতি, বহু গল্প জড়িয়ে আছে জ্যোৎস্না আর এ রাস্তার সাথে।
আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের ঘটনা। আমার বয়স তখন বারো কি তেরো। কোন এক জ্যোৎস্নারাতে এভাবেই হাঁটছিলাম একাকি আনমনে। হঠাৎ গোরস্তানের ভেতর থেকে কিসের একটা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর শব্দ এলো। কবরের উপরে গজে উঠা প্রায় দুই থেকে তিনহাত লম্বা লম্বা ঘাসগুলো এলোমেলো করে দুলছিলো। সাথে থেমে থেমে অদ্ভুতরকমের শব্দ ভেসে আসছে। ভীষণ ভয়ে আঁতকে উঠে কয়েক কদম পেছনে ছিটকে পড়লাম। ঘাসগুলোর অস্বাভাবিক নৃত্য ক্রমেই আমার দিকে এগোতে লাগলো। ভয়ে আমি যখন পুরোটাই কাঠ, ঠিক তখনই দেখি ঘাসের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো দুটা বিড়াল! একটা কালো, আর একটা সাদা। আমাকে দেখে ঝগড়া থামিয়ে যে যার পথ বেছে নিলো। বিড়ালের বিটলামো দেখে আমি তো থ। মেঁউ শুনলে আগেই না হয় বুঝে ফেলতাম এসব বিড়ালদের কারসাজি। কিন্তু ঝগড়ার সময় বিড়ালসমাজ আজব কিছিমের শব্দ করে। তাই বুঝার জোঁ ছিলো না। আমার দাদার অবস্থাও বিড়াল মার্কা ছিলো। রাগ উঠলে তাঁর মুখের ভাষা কারো বুঝে আসতো না। কোন সাধনে তিনি যে এ সকল ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, সেটাও এক বিরাট ধাঁধা হয়ে রইলো আমার কাছে। যাক গে, এসব মধুর স্মৃতি আউড়িয়ে জান্নাতবাসি দাদার আজাব ভারি করতে চাই না। স্কুলে স্যারের মারের ভয়ে ভেতরে ভেতরে মরে যাওয়ার পর যখন দেখা যেত স্যারের মোড আকস্মিকভাবে ভালো থাকাতে টু শব্দও করলো না, তখনকার মনের যা অবস্থা হতো, সেদিনও বিড়ালদ্বয়ের ভুত মার্কা হাঁকডাক আর শেষে ইঁদুর মার্কা যবনিপাত দেখে ঠিক তাই হলো। সেদিনের পর অনেকদিন আর এ রাস্তা দিয়ে হাঁটা হয় নি। পরে আবারো অভ্যাস হয়ে গেলো। মানুষ অভ্যাসের দাস। আজকেও পুরোনো অভ্যাসটাকে একটু চাঙা করার লক্ষ্যে হাঁটছি। সামনেই তেরাস্তার মাথা। নবাব বাহাদুরের বাড়ি থেকে সোজা এসে তৃতীয় রাস্তাটা এটার মাঝখানে বামহাত ঢুকিয়েছে। অর্থাৎ যুক্ত হয়েছে। ওদিক থেকে কে যেন আসছে। আবছা আলোয় আপাতত ভুতের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে না..................
চলবে............
নবাবপুরের হালচাল(৩)
-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন