সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নবাবপুর ৩

মৃত্যুটা আসলেই একটা ধাঁধা। দেখুন না, বেঁচে থাকা সম্ভব না জেনেও বেঁচে থাকার কত আয়োজন। অথচ না চাইতেই যে মরতে হবে, তার জন্য মানুষের আয়োজন অতি সামান্য। কেমন বেখাপ্পা বেখাপ্পা লাগে না? আচ্ছা, মানুষের কি মরে যাওয়া উচিৎ, নাকি বেঁচে থাকা? হাবিল-কেনান-এজিদ-জাফরদের স্মরণ করলে মনে হয় মরে যাক। আবার কাবিল থেকে শুরু করে মহামানবদের স্মরণ এলে মনে হয় জনম জনম মানুষদের বেঁচে থাকা উচিৎ। কিছু মানুষ অদ্ভূতভাবে বেঁচে থেকে মরে যায়। আবার কেউ কেউ মরেও বেঁচে থাকে হাজার বছর ধরে। যার দুনিয়াতে কেউ নেই, অথবা যে জন্মান্ধ। কিংবা আজন্ম যে মূক(বোবা), সে কি আসলেই বেঁচে থাকার কোন মানে খোঁজে পায়? আবার দুঃখু মিয়ারা দেখি আজীবন দুঃখ-কষ্ট সয়ে সয়ে মরেও আজ অবদি অবলিলায় বেঁচে আছে। ধাঁধাময় দ্যোতনা। বহুরূপি ইঙ্গিত।


এসব ভাবতে ভাবতে মরাবাড়ি(কবরস্থান) দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পথ প্রায় অর্ধেকটা পেছন ফেলে এসেছি। চাঁদটাও দেখি আমার সাথে সাথে আসছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে ওর যৌবনলীলাও বেড়ে চলেছে। ছোট বেলায় এটা নিয়ে বন্ধুদের সাথে বেশ ঝগড়া বাঁধাতাম। সবার দাবি থাকতো চাঁদটা তার বরাবর। বড় হয়ে বুঝলাম আসলে আমরা প্রত্যেকেই চাঁদ বরাবর। ভালোই হলো। যেহেতু সঙ্গি কেউ নেই, তাই এই ভেবে ভালো লাগছে যে, অন্তত মাহতাববাবু হলেও এই সঙ্গিহীন মানুষটাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। ছোটবেলা থেকেই এই জ্যোৎস্না আমার খুব প্রিয়। প্রায় জ্যোৎস্নারাতেই এই রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটতাম। তাই বহু স্মৃতি, বহু গল্প জড়িয়ে আছে জ্যোৎস্না আর এ রাস্তার সাথে। 


আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের ঘটনা। আমার বয়স তখন বারো কি তেরো। কোন এক জ্যোৎস্নারাতে এভাবেই হাঁটছিলাম একাকি আনমনে। হঠাৎ গোরস্তানের ভেতর থেকে কিসের একটা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর শব্দ এলো। কবরের উপরে গজে উঠা প্রায় দুই থেকে তিনহাত লম্বা লম্বা ঘাসগুলো এলোমেলো করে দুলছিলো। সাথে থেমে থেমে অদ্ভুতরকমের শব্দ ভেসে আসছে। ভীষণ ভয়ে আঁতকে উঠে কয়েক কদম পেছনে ছিটকে পড়লাম। ঘাসগুলোর অস্বাভাবিক নৃত্য ক্রমেই আমার দিকে এগোতে লাগলো। ভয়ে আমি যখন পুরোটাই কাঠ, ঠিক তখনই দেখি ঘাসের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো দুটা বিড়াল! একটা কালো, আর একটা সাদা। আমাকে দেখে ঝগড়া থামিয়ে যে যার পথ বেছে নিলো। বিড়ালের বিটলামো দেখে আমি তো থ। মেঁউ শুনলে আগেই না হয় বুঝে ফেলতাম এসব বিড়ালদের কারসাজি। কিন্তু ঝগড়ার সময় বিড়ালসমাজ আজব কিছিমের শব্দ করে। তাই বুঝার জোঁ ছিলো না। আমার দাদার অবস্থাও বিড়াল মার্কা ছিলো। রাগ উঠলে তাঁর মুখের ভাষা কারো বুঝে আসতো না। কোন সাধনে তিনি যে এ সকল ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, সেটাও এক বিরাট ধাঁধা হয়ে রইলো আমার কাছে। যাক গে, এসব মধুর স্মৃতি আউড়িয়ে জান্নাতবাসি দাদার আজাব ভারি করতে চাই না। স্কুলে স্যারের মারের ভয়ে ভেতরে ভেতরে মরে যাওয়ার পর যখন দেখা যেত স্যারের মোড আকস্মিকভাবে ভালো থাকাতে টু শব্দও করলো না, তখনকার মনের যা অবস্থা হতো, সেদিনও বিড়ালদ্বয়ের ভুত মার্কা হাঁকডাক আর শেষে ইঁদুর মার্কা যবনিপাত দেখে ঠিক তাই হলো। সেদিনের পর অনেকদিন আর এ রাস্তা দিয়ে হাঁটা হয় নি। পরে আবারো অভ্যাস হয়ে গেলো। মানুষ অভ্যাসের দাস। আজকেও পুরোনো অভ্যাসটাকে একটু চাঙা করার লক্ষ্যে হাঁটছি। সামনেই তেরাস্তার মাথা। নবাব বাহাদুরের বাড়ি থেকে সোজা এসে তৃতীয় রাস্তাটা এটার মাঝখানে বামহাত ঢুকিয়েছে। অর্থাৎ যুক্ত হয়েছে। ওদিক থেকে কে যেন আসছে। আবছা আলোয় আপাতত ভুতের চেয়ে বেশি কিছু মনে হচ্ছে না..................


চলবে............

নবাবপুরের হালচাল(৩)

-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...