একটি বিকেল, অতঃপর...
-মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
পড়ন্ত বিকেল। একটু আগেই আসরের নামাজটা শেষ করে মসজিদ থেকে বের হলাম। মসজিদের বামে কবরস্তান। এর বামে মাঠ। মাঠের বামে বহুবছরের পুরোনো মাজার। যিনি শায়িত আছেন তাঁর নাম ‘হযরত গোলাম হোসাইন শাহ।’ সাথে মাদরাসাও আছে একটা। এর পশ্চিমে বাগান। সুযোগ থাকলে গোধুলিটা উপভোগ না করে ছাড়ি না। একপা দুপা করে চলে গেলাম বাগানের শেষমাথায়। একদম পশ্চিম কোণায়।
লোকজন নেই। এদিকটা লোকশূন্য। গোধুলী উপভোগের জন্য এরচে ভালো জায়গা হয় না। সামনে বিস্তৃত ধানক্ষেত। ভিন্ন ভিন্ন দূরত্বে পশ্চিম ও দক্ষিণে ছোট ছোট টিলায় ঘেরা। কাটাগাছের একটা গোড়ায় কিছু পাতাযুক্ত ছোট ছোট ঢাল পেতে বসে পড়লাম। আজকের গোধুলী একটু আগেভাগে চলে এসেছে। আকাশে প্রচুর মেঘ। সূর্য দেখা যাচ্ছে না। গেলে খারাপ হতো। পশ্চিম দিকে মুখ করে বসা যেত না। শিরশির বাতাস বইছে। পাঞ্জাবির বোতাম খুলে দিলাম।
ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছি। হলদে ভাবটা চলে গেছে। গাঁড় সবুজ রং ধারণ করেছে। মনোরম দৃশ্য। এ দেশের কৃষকরা একেকজন বিরাটমানের শিল্পী। কত নিখুঁত এঁদের নিশানা। ধানের গোছাগুলো কোন যন্ত্র ছাড়াই এমনভাবে রোপন করছে যে, সেগুলির দূরত্বে হেরফের নেই। সারি সারি। বাতাসে সেগুলির অগ্রভাগ দুলছে। বাতাসের গতির হ্রাসবৃদ্ধিতে দোলার গতির তারতম্য সৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে গেল। বাতাস না আসলে গাছের পাতা নড়ে না। হাত দিয়ে একটা ধানগাছের অগ্রভাগ নাড়িয়ে বাক্যটা মিথ্যা বানিয়ে দিলাম। নড়স না ক্যান? এই ব্যাটা নড়! নড় বলছি...
হুকুমে কাজ হলো। আবার নড়া শুরু করল। বাতাস এসে গেছে। সাথে হালকা বৃষ্টিও। খুবই হালকা। ফোটাগুলো গণ্ডদেশ, নাসিকা, কর্ণ, ওষ্ঠাধর ছোঁয়ে দিচ্ছে। যেন এদের সাথে আমার বহুবছরের প্রেম। গলায় গলায় ভাব। বিনা আমন্ত্রণে এদের এত প্রেম নিবেদনে খানিকটা সন্দেহ জাগলো। সন্দেহ সত্য হলো। দূরে ঝড়ের গর্জন শোনা যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ বসা যেত। তবে প্রেমের জলে ডুবে মরতে হবে। উঠে গেলাম। একদৌড়ে গিয়ে পড়লাম চা’র দোকানে। লোকজন কম। সওদাগর চেনা লোক। তুইতুকারির সম্পর্ক। ঐ চা দে।
-ধর।
-মানে কী?
-আরেকজনর লাই বানাইজি। ইতে নহাদ্দে। (আরেকজনের জন্য বানিয়েছি। সে খাচ্ছে না)
চায়ে টান দিলাম। মোটামোটি ভালো হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। দোকানের ছাদ টিনের হওয়ায় সুবিধে হলো। টিনের ছাদ না হলে বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শোনা যায় না। এ শব্দ না শুনতে পেলে বৃষ্টি হওয়ার দরকারটা কী?
চা শেষ। বৃষ্টিও শেষ। ইলশেঘুড়ি বলবৎ। রাস্তা মাফা শুরু করলাম। অর্ধেকটা যেতে না যেতে আবারো বর্ষণ শুরু। প্রথমে ভাবলাম দৌড় দেই। পরে ভাবলাম না, ভিজি। এভাবে ঝুপবৃষ্টিতে ভেজা হয় না অনেক দিন। উন্মুক্ত আকাশের নিচে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিলাম। বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয় না জোরে...
একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। থামাথামির লক্ষণ নেই। আমিও ভিজে চলেছি। আমাকে দেখে বৃষ্টির আনন্দ বেড়ে গেলো। আনন্দ না রাগ বুঝা যাচ্ছে না। অধিক শক্তি সঞ্চয় করে জেদি মেজাজে ঝরে চলেছে। অনেক্ষণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার একধারে। ভালো লাগছে। ভীষণ ভালো লাগছে। বৃষ্টিতে আগেও বহুবার ভিজেছি। এত উপভোগ কখনো করি নি।
চোখ খুললাম। সিএনজি, সাইকেল ছাড়াও ছাতা হাতে অনেকে হেঁটে অতিক্রম করছে আমাকে। সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। যেন আমি অদ্ভুত জীব! তাদের তাকানোটা অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কেউ কেউ হাসছেও। কী আজিব! আমি কি হাসার পাত্র? একটা মানুষ ভিজতেও পারবে না?
বৃষ্টি থেমে গেছে। দুয়েকদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে। ঘরে যাওয়া যাক। ভিজে যা মাখামাখি অবস্থা হয়েছে না, গোসল করতে হবে।
গোসল শেষ। নামাজও শেষ। মন-মস্তিস্ক ভালো না। দুটাই বিকারগ্রস্থ। মাথায় বড়োধরণের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সারাক্ষণ চিকচিক করছে। কদিনধরেই এমন চলছে। এতক্ষণ ‘ভেজা পাগলামি’র কারণ ওটাই। দরবার যাব। মাইজভাণ্ডার দরবার। বেলায়তের আড্ডাখানা। অশান্ত মনের শান্তির ঠিকানা। চোখের তৃপ্তি, হৃদয়ের ব্যাপ্তি।
আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। অজু করলাম পুকুরে। মাথায় পানিও দিলাম খানিকটা। ভালো লাগছে। নিয়ত বিশুদ্ধ থাকলে এ পানি শেফা হয়ে কাজ করে। মকামে মকসুদে পৌঁছে গেছি। কুরআনের নকশা করা সে ঘরে। আত্মার মুর্শিদ ‘প্র্যাকটিকেল কুরআন’ হযরতের রওজায়। অনাবিল শান্তির অনন্য স্থান। কদমে চুপচাপ বসে পড়লাম। মুখ দিয়ে কিছু বেরোচ্ছে না। বোবা হয়ে গেছি। হযরতের রওজায় গেলে আমি বোবা হয়ে যাই। মুখ নেড়ে কিছু পড়তে পারি না। হাত তুললে কিছু চাইতে পারি না। হযরতের বাণী- ‘যে কেহ আমার সাহায্য প্রার্থনা করিবে, তাহাকে আমি উন্মুক্ত সাহায্য করিব। আমার গাউছিয়ত সরকারের এই প্রকৃতি হাসরতক জারি থাকিবে।’ এ বাণীটা কার জন্য করেছিলেন কে জানে। আমার জন্য মনে হয়, না। নতুবা মুখ দিয়ে কিছু বেরোই না কেন? অধিক শোকে নাকি পাথর। এ কেমন শোক, কেমন খেলা বুঝে উঠতে পারছি না। অচেনা কোন অইন্দ্রিয় শক্তি আঁটকে দেয়। নাম না জানা কোনো এক গভীরজলের লেখক এভাবে লিখেছিলেন-
“আরজিয়াঁ সারি মাই,
চেহরে পে লিখকে লায়াহুঁ,
তুমছে কেয়া মাঙ্গু মাই,
তুম খুদ হি সামাঝলো মউলা।”
আত্মার খেলা শুরু। মাথা ঝুঁকে যাচ্ছে সামনের দিকে। অনিচ্ছাকৃত। শরীয়ত পেছন থেকে টেনে ধরেছে। কপাল ঠেকানো চলবে না। কিন্তু কপাল ঠেকে গেছে। উপুড় হয়ে পড়ে গেছি। অনেক্ষণ পড়ে রইলাম। অচলাবস্থা...
এশার সময় হয়ে গেছে। রওজার সাথেই ইবাদতখানা। উঠে গিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম। নামাজে এত তৃপ্তি সবসময় পাওয়া যায় না। একাগ্রচিত্তে অবনত মস্তকে। আহ, শান্তি!
নামাজ শেষে আবারো কদম মোবারক বরাবর বসে পড়লাম। জিয়ারতের নিয়ম পশ্চিম পাশে পুর্বদিকে মুখ করে দাঁড়ানো। আমি কদমেই আঁটকে গেলাম। এখানকার সবকিছু অদ্ভুত নিয়মে চলতে থাকে। কে যেন লিখেছিলেন-
‘আমার গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারী আজব শানে খেলেরে
নুরছে আপনা বদন বানায়া নুরছে রশ্নি জ্বলেরে...’
নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার চেয়ে আত্মার বাঁধন বড়ো হয়ে দাঁড়ায় এখানে। স্রোতের বিপরীত চলতে বাধ্য করে। আমিও সে বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছি।
কতক্ষণ বসে ছিলাম হিসেব নেই। ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে না। এখানে ঘড়ির হিসেবে চলা অনর্থক মনে হচ্ছে। এখানে ঘড়ি চলবে অন্য এক হিসেবে। সে হিসেবটা আপাতত তোলা থাক। বিনয়াবনত মস্তকে ধীরপায়ে বেরিয়ে পড়লাম। শান্তি অনুভূত হচ্ছে। মনে হয় কাজ হয়ে গেছে। মাথাব্যথাও চলে গেছে। এ এক আজব ডাক্তারের আজব কারখানা। বাকি রওজাগুলোর জিয়ারতও শেষ হলো। ঘড়িতে টাইম দেখি ন’টা চল্লিশ। বাড়ি ফিরতে হবে। এএএএই সিএনজিইইই...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন