অদ্ভুত ভজনালয়ে একদিন
৭ শাওয়াল। ঈদের সপ্তম দিন। আমরা ক’জন হেঁটে চলেছি। উঁচুনিচু পাথুরে পথ বেয়ে। জায়গাটা রাউজান ডিঙিয়ে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে ঠেকেছে। সম্ভবত ‘কাউখালি’ পড়েছে। ভাঙাচোরা এক সাইন বোর্ডে দেখলাম ‘ফটিকছড়ি ইউনিয়ন’। বাহ, ফটিকছড়ি থানা থেকে সোজা ফটিকছড়ি ইউনিয়নে! অদ্ভুত! আমার সাথে জিয়া, বেলাল, ফয়েজ, আরিফ ও আরমান ভাই। হাতে বাঁশের যষ্টি। যষ্টি অন্ধের না হলেও বেশ কাজের। উপরে বানরের লাফঝাঁপ। নিচে পিচ্ছিল পথ। বানরকে ভয় দেখানো, পিচ্ছিল পথে সামনে আগানো। দুটাতেই কাজে লাগছে। পাহাড় চুপসে গড়িয়ে আসা গিরিপথের শীতল পানি পায়ে লাগছে। অনুভবটা পায়ের গোড়ালি হয়ে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। উপরের রোদ্রের খরতাপ তখন ক্লান্তি আনতে অক্ষম। নতুন স্বাদের সন্ধানেই যে বেরিয়েছি। সেটা না-পাওয়া পর্যন্ত ক্লান্তি এলে কি চলবে?
বেশ আগ্রহ নিয়েই সামনে চলা। কোনো বাধাই যেন প্রতিবন্ধক নয়৷ দুয়েকজন সামান্য ভয় পাচ্ছে। আমাকে আপাতত ভয়টয় ওসবে কাবু করতে পারছে না। মনজিলে মকসুদে পৌঁছুতে হবে৷ মনজিলে মকসুদ নিচে জানতে পারবেন। তার আগে আপাতত কয়েকটা সেলফি হয়ে যাক। আরিফ ভাইয়ের যুক্তি ফেলবার নয়। ফেরার সময় এসবে ইন্টারেস্ট থাকে না। অল্পসময়ে কিঞ্চিৎ ভেবে দেখলাম। আসলেই থাকে না। সে কথা থাক। সামনে যাই।
অনেক পথ পাড়ি দেয়া হলো। প্রায় তিন কি.মি.। সামনে কি যেন দেখা যাচ্ছে। হুমমম, দৈত্যাকৃতির পাহাড়ের মাঝখানটায় একটা গর্ত। কিন্তু ভিন্ন। নিচে মোমবাতির গলে যাওয়া মোমের সমাবেশ। পাশে আগর বাতি জ্বলছে। একটু আগেই কে যেন ধরিয়েছে। আরেকটু সামনে যাওয়া যাক। আরো একটা গর্ত। এটা বেশ বড়ো। পাহাড়ের অগ্রভাগ থেকে ক্রমে ভেতর দিকে সংকোচিত হয়ে ঠিক গোড়ায় এসে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। প্লাস্টিকের জায়নামাজ পাতা। যে কেউ বসে থাকতে পারে। বৃষ্টি কিংবা রোধ কোনোটাই ঝামেলা বাধাতে পারবে না। তবে পাহাড়-চুপসানো জল যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হতে পারে।
আরেকটু অগ্রসর হই। অদ্ভুত কাণ্ড! আরো একটি গোহা। দুদিক থেকে মুখ। একটা দরজা হলে অপরটাকে জানালা ধরা যায়। নিচ থেকে বেশ উঁচু বলে লোহার সিড়ি লাগানো। অজু করে উঠে গেলাম। মাথাটা কিয়দংশ ঢুকিয়ে দিলাম। অদ্ভুত এক গন্ধ। মাটির এমন গন্ধ ইতোপূর্বে কোথাও পেয়েছি বলে মনে হয় না। এখানেও মোমবাতি জ্বলছে। বুঝাই যাচ্ছে, নিয়মিত মানুষের আনাগোনা খুব। প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ আসে।
কিন্তু একটু পেছন ফিরে যেতে হবে। ঠিক ১০০ বছর পেছনে। তখনও একজন এসেছিলেন। আমাদের মতো দলবেঁধে নয়। একদম একা। এক মহা সাধক। কিংবদন্তি তপস্বী। থেকেছেন একনাগাড়ে ১২ বছর। আজকালকার দিনেও এ পথে আসতে গা-চমচম অবস্থা। একলা আসতে কেউ তেমন একটা সাহস করে না৷ তাই দলবেঁধে আসে। কারণ, এ এক ঐতিহাসিক স্থান। সে ইতিহাস ১০০ বছরের পুরোনো। সে সময়কার কথাটা একবার ভাবুন। না-ছিল জনমানব, না-ছিল পথঘাট। কীভাবে, কেন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর?
কারণ আছে। বিশাল কারণ। এর আগে শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শকরের কাহিনী পড়েছিলাম। তিন বারো ৩৬ বছরের নাগাতার সাধনা। বড়োপীর করেছেন ৪০ বছর। এভাবে আরো বহু উদাহরণ আছে। সবই তপস্যাধারী সম্রাট। একাগ্রে নির্জন বনবাদাড়ে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। কী বুঝলেন? গদিতে বসে খোদা পাওয়া সম্ভব না। সাধনা লাগবে। কঠোর সাধনা। হোক তা বনবাদাড় অথবা অন্য কোথাও। সে যতোই ডিগ্রিধারী অলির বংশধর, সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হোক-না কেন। মাইন্ড ইট।
এমন কঠোর কথা কীভাবে বললাম? বলছি তবে, পড়ুন। এ মহাপুরুষের পরিচয় দিলে বুঝতে পারবেন। গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হজরত কেবলা আহমদ উল্লাহ (ক.) এর ভাষায় ‘ইউসুফে সানি’। ইমাম শেরে বাংলা মাইজভাণ্ডারের যে দুজনকে ‘গাউছুল আজম’ বলেছেন, তাদের একজন। সবাই বলে ‘বাবা-ভাণ্ডারী’। মূল নাম ‘গোলামুর রহমান’। ব্যাপারটা মিলে গেল? দুধকা দুধ, পানিকা পানি? হজরত কেবলার এত কাছের লোক, ফয়েজপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও যদি গহীন অরণ্যে সাধনার বীণ বাজাতে হয়, তবে গদির নরম গালিচায় খোদার সন্ধান? ঐ যে পুরান কথাটা–‘আকাশকুসুম’।
লেখা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেছি। গোহায় ফিরে আসি। গোহা না-বলে ভজনালয় বলি। ভজন মানে সাধনা। ভজনালয় মানে সাধনার ঘর। সেই দ্বিতীয় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছি। বেলাল ভাই মিলাদের সুর তোলেছে,
“সালাতুন ইয়া রাসুলাল্লাহ আলাইকুম
সালামুন ইয়া হাবিবাল্লাহ আলাইকুম।”
আমরাও পড়ছি। আমরা ছয়জন ছাড়া অচেনা আরো বারোজন যুক্ত হলো। কিয়াম শেষ পর্যায়ে। জিয়া ভাই গান ধরেছে। বড়ো মোহনীয় গান। বড়ো অভিমানী সুর।
“নাম ধরেছ রহমান, দয়ার সীমা নাই,
খালি হাতে কেউ ফিরে না তোমার কাছে যাই,
আমার বেলায় দয়া দানে হও কেন কৃপণ,
প্রেম আগুনে জ্বালাই মারো সারাটি জীবন।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন