সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অদ্ভুত ভজনালয়২

অদ্ভুত ভজনালয়ে একদিন

৭ শাওয়াল। ঈদের সপ্তম দিন। আমরা ক’জন হেঁটে চলেছি। উঁচুনিচু পাথুরে পথ বেয়ে। জায়গাটা রাউজান ডিঙিয়ে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে ঠেকেছে। সম্ভবত ‘কাউখালি’ পড়েছে। ভাঙাচোরা এক সাইন বোর্ডে দেখলাম ‘ফটিকছড়ি ইউনিয়ন’। বাহ, ফটিকছড়ি থানা থেকে সোজা ফটিকছড়ি ইউনিয়নে! অদ্ভুত! আমার সাথে জিয়া, বেলাল, ফয়েজ, আরিফ ও আরমান ভাই। হাতে বাঁশের যষ্টি। যষ্টি অন্ধের না হলেও বেশ কাজের। উপরে বানরের লাফঝাঁপ। নিচে পিচ্ছিল পথ। বানরকে ভয় দেখানো, পিচ্ছিল পথে সামনে আগানো। দুটাতেই কাজে লাগছে। পাহাড় চুপসে গড়িয়ে আসা গিরিপথের শীতল পানি পায়ে লাগছে। অনুভবটা পায়ের গোড়ালি হয়ে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। উপরের রোদ্রের খরতাপ তখন ক্লান্তি আনতে অক্ষম। নতুন স্বাদের সন্ধানেই যে বেরিয়েছি। সেটা না-পাওয়া পর্যন্ত ক্লান্তি এলে কি চলবে?

বেশ আগ্রহ নিয়েই সামনে চলা। কোনো বাধাই যেন প্রতিবন্ধক নয়৷ দুয়েকজন সামান্য ভয় পাচ্ছে। আমাকে আপাতত ভয়টয় ওসবে কাবু করতে পারছে না। মনজিলে মকসুদে পৌঁছুতে হবে৷ মনজিলে মকসুদ নিচে জানতে পারবেন। তার আগে আপাতত কয়েকটা সেলফি হয়ে যাক। আরিফ ভাইয়ের যুক্তি ফেলবার নয়। ফেরার সময় এসবে ইন্টারেস্ট থাকে না। অল্পসময়ে কিঞ্চিৎ ভেবে দেখলাম। আসলেই থাকে না। সে কথা থাক। সামনে যাই। 

অনেক পথ পাড়ি দেয়া হলো। প্রায় তিন কি.মি.। সামনে কি যেন দেখা যাচ্ছে। হুমমম, দৈত্যাকৃতির পাহাড়ের মাঝখানটায় একটা গর্ত। কিন্তু ভিন্ন। নিচে মোমবাতির গলে যাওয়া মোমের সমাবেশ। পাশে আগর বাতি জ্বলছে। একটু আগেই কে যেন ধরিয়েছে। আরেকটু সামনে যাওয়া যাক। আরো একটা গর্ত। এটা বেশ বড়ো। পাহাড়ের অগ্রভাগ থেকে ক্রমে ভেতর দিকে  সংকোচিত হয়ে ঠিক গোড়ায় এসে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। প্লাস্টিকের জায়নামাজ পাতা। যে কেউ বসে থাকতে পারে। বৃষ্টি কিংবা রোধ কোনোটাই ঝামেলা বাধাতে পারবে না। তবে পাহাড়-চুপসানো জল যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হতে পারে। 

আরেকটু অগ্রসর হই। অদ্ভুত কাণ্ড! আরো একটি গোহা। দুদিক থেকে মুখ। একটা দরজা হলে অপরটাকে জানালা ধরা যায়। নিচ থেকে বেশ উঁচু বলে লোহার সিড়ি লাগানো। অজু করে উঠে গেলাম। মাথাটা কিয়দংশ ঢুকিয়ে দিলাম। অদ্ভুত এক গন্ধ। মাটির এমন গন্ধ ইতোপূর্বে কোথাও পেয়েছি বলে মনে হয় না। এখানেও মোমবাতি জ্বলছে। বুঝাই যাচ্ছে, নিয়মিত মানুষের আনাগোনা খুব। প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ আসে।

কিন্তু একটু পেছন ফিরে যেতে হবে। ঠিক ১০০ বছর পেছনে। তখনও একজন এসেছিলেন। আমাদের মতো দলবেঁধে নয়। একদম একা। এক মহা সাধক। কিংবদন্তি তপস্বী। থেকেছেন একনাগাড়ে ১২ বছর। আজকালকার দিনেও এ পথে আসতে গা-চমচম অবস্থা। একলা আসতে কেউ তেমন একটা সাহস করে না৷ তাই দলবেঁধে আসে। কারণ, এ এক ঐতিহাসিক স্থান। সে ইতিহাস ১০০ বছরের পুরোনো। সে সময়কার কথাটা একবার ভাবুন। না-ছিল জনমানব, না-ছিল পথঘাট। কীভাবে, কেন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর? 

কারণ আছে। বিশাল কারণ। এর আগে শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শকরের কাহিনী পড়েছিলাম। তিন বারো ৩৬ বছরের নাগাতার সাধনা। বড়োপীর করেছেন ৪০ বছর। এভাবে আরো বহু উদাহরণ আছে। সবই তপস্যাধারী সম্রাট। একাগ্রে নির্জন বনবাদাড়ে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। কী বুঝলেন? গদিতে বসে খোদা পাওয়া সম্ভব না। সাধনা লাগবে। কঠোর সাধনা। হোক তা বনবাদাড় অথবা অন্য কোথাও। সে যতোই ডিগ্রিধারী অলির বংশধর, সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হোক-না কেন। মাইন্ড ইট। 

এমন কঠোর কথা কীভাবে বললাম? বলছি তবে, পড়ুন। এ মহাপুরুষের পরিচয় দিলে বুঝতে পারবেন। গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী হজরত কেবলা আহমদ উল্লাহ (ক.) এর ভাষায় ‘ইউসুফে সানি’। ইমাম শেরে বাংলা মাইজভাণ্ডারের যে দুজনকে ‘গাউছুল আজম’ বলেছেন, তাদের একজন। সবাই বলে ‘বাবা-ভাণ্ডারী’। মূল নাম ‘গোলামুর রহমান’। ব্যাপারটা মিলে গেল? দুধকা দুধ, পানিকা পানি? হজরত কেবলার এত কাছের লোক, ফয়েজপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও যদি গহীন অরণ্যে সাধনার বীণ বাজাতে হয়, তবে গদির নরম গালিচায় খোদার সন্ধান? ঐ যে পুরান কথাটা–‘আকাশকুসুম’।

লেখা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেছি। গোহায় ফিরে আসি। গোহা না-বলে ভজনালয় বলি। ভজন মানে সাধনা। ভজনালয় মানে সাধনার ঘর। সেই দ্বিতীয় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছি। বেলাল ভাই মিলাদের সুর তোলেছে,
“সালাতুন ইয়া রাসুলাল্লাহ আলাইকুম
সালামুন ইয়া হাবিবাল্লাহ আলাইকুম।”
আমরাও পড়ছি। আমরা ছয়জন ছাড়া অচেনা আরো বারোজন যুক্ত হলো। কিয়াম শেষ পর্যায়ে। জিয়া ভাই গান ধরেছে। বড়ো মোহনীয় গান। বড়ো অভিমানী সুর।
“নাম ধরেছ রহমান, দয়ার সীমা নাই,
খালি হাতে কেউ ফিরে না তোমার কাছে যাই,
আমার বেলায় দয়া দানে হও কেন কৃপণ,
প্রেম আগুনে জ্বালাই মারো সারাটি জীবন।”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...