সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অদ্ভুত ভজনালয়

অদ্ভুত ভজনালয়ে একদিন
–মুহাম্মদ সৈয়দুল হক

৭ শাওয়াল। ঈদের সপ্তম দিন। আমরা ক’জন হেঁটে চলেছি। উঁচুনিচু পাথুরে পথ বেয়ে। জায়গাটা রাউজান ডিঙিয়ে রাঙ্গামাটিতে গিয়ে ঠেকেছে। নামটা সম্ভবত ‘কাউখালী’। ভাঙাচোরা এক সাইন বোর্ডে দেখলাম ‘ফটিকছড়ি ইউনিয়ন’। গিয়েছিলাম ফটিকছড়ি থানা থেকে। বাহ, থানা থেকে সোজা ফটিকছড়ি ইউনিয়ন! মানের বেশ উন্নতি হয়েছে, অদ্ভুত! আমার সাথে জিয়া, বেলাল, ফয়েজ, আরিফ ও আরমান ভাই। হাতে বাঁশের যষ্টি। যষ্টি অন্ধের না হলেও বেশ কাজের। উপরে বানরের লাফঝাঁপ, নিচে পিচ্ছিল পথ। বানরকে ভয় দেখানো, পিচ্ছিল পথে সামনে আগানো। দুটাতেই কাজে লাগছে। পাহাড় চুপসে গড়িয়ে আসা গিরিপথের শীতল পানি পা বেয়ে নিচের দিকে ছুটছে। অনুভবটা পায়ের গোড়ালি হয়ে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। উপরের রোদ্রের খরতাপ তখন ক্লান্তি আনতে অক্ষম। নতুন স্বাদের সন্ধানেই যে বেরিয়েছি। সেটা না-পাওয়া পর্যন্ত ক্লান্তি এলে কি চলবে?

বেশ আগ্রহ নিয়েই সামনে চলছি। অনেকটা পথ পেছন ফেলে এসেছি। সামনে থেকে তিনটা কুকুর এলো হঠাৎ৷ দুয়েকবার ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের সামনে সামনে হাঁটতে লাগল। ঠিক যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। আমরা আমাদের মতো হাঁটছি। কুকুরগুলো কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর পেছন ফিরে তাকায়। সজাগ দৃষ্টি। অচেনা আমাদের প্রতি কুকুরগুলোর দায়িত্ববোধ অবাক করার মত। মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ববোধের চরম দুর্গতির এ সময়ে এমন দৃশ্যে চোখের কোণে জলের সঞ্চার হলো। লোকমুখে প্রচলিত একটি কথা আছে। এখানে নতুন কেউ এলে কুকুরগুলো তাদের পথ দেখাতে এগিয়ে আসে। আজ প্রমাণ পেয়ে গেলাম, অদ্ভুত! 

ছোট ছোট পাথরে পা পড়ে তালুতে বেশ লাগছে। দুয়েকজন সামান্য ভয় পাচ্ছে। আমাকে আপাতত ভয়টয় ওসবে কাবু করতে পারছে না। কোনো বাধাই যেন প্রতিবন্ধক নয়৷ মনজিলে মকসুদে পৌঁছুতে হবে৷ মনজিলে মকসুদ পরে জানা যাবে। তার আগে আপাতত কয়েকটা সেলফি হয়ে যাক। আরিফ ভাইয়ের যুক্তি ফেলবার নয়। ফেরার সময় এসবে ইন্টারেস্ট থাকে না। অল্পসময়ে কিঞ্চিৎ ভেবে দেখলাম, আসলেই থাকে না। তাই ঝটপট কয়েকটা ছবি তোলা হয়ে যাক। পাহাড়ি গিরিপথের সাথে আমাদের চেহেরাগুলো ক্যামেরার মাধ্যমে মোবাইলে বন্ধি হলো। এবার আগানো যাক। 

অনেক পথ পাড়ি দেয়া হলো। প্রায় তিন কি.মি.। গিরিপথের এ জায়গার একটি পাশ একটু চওড়া। সেখানটাই একটা কুঁড়েঘর। আধবয়সী এক পাহাড়ি বের হলো। পাহাড়ি হলেও চট্টগ্রামের ভাষা জানে। গন্তব্যের কথা জিজ্ঞেস করতেই চট্টগ্রামের ভাষায় সামনে দেখিয়ে দিল। কয়েক কদম যাওয়ার পরেই কি যেন দেখা যাচ্ছে। হুমমম, দৈত্যাকৃতির পাহাড়ের মাঝখানটায় একটা গর্ত। গর্ত হলেও ভিন্ন। নিচে মোমবাতির গলে যাওয়া মোমের সমাবেশ। পাশে আগর বাতি জ্বলছে। একটু আগেই কে যেন ধরিয়েছে। আরেকটু সামনে যাওয়া যাক। আরো একটা গর্ত। এটা বেশ বড়ো। পাহাড়ের অগ্রভাগ থেকে ক্রমে ভেতর দিকে সংকোচিত হয়ে ঠিক গোড়ায় এসে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। প্লাস্টিকের জায়নামাজ পাতা। যে কেউ বসে থাকতে পারে। বৃষ্টি কিংবা রোদ কোনোটাই ঝামেলা বাধাতে পারবে না। তবে পাহাড়-চুপসানো জল যথেষ্ট বিরক্তির কারণ হতে পারে। 

আরো একটু অগ্রসর হওয়া যাক। অদ্ভুত কাণ্ড! আরো একটি গর্ত। দুদিক থেকে মুখ। অনেকটা গুহার মতো। একটা দরজা হলে অপরটাকে জানালা ধরা যায়। নিচ থেকে বেশ উঁচু বলে লোহার সিড়ি লাগানো। অজু করে উঠে গেলাম। মাথাটা কিয়দংশ ঢুকিয়ে দিলাম। অদ্ভুত এক গন্ধ। মাটির এমন গন্ধ ইতোপূর্বে কোথাও পেয়েছি বলে মনে হয় না। স্বর্গীয় অনুভূতি। এখানেও মোমবাতি জ্বলছে। বুঝাই যাচ্ছে, নিয়মিত মানুষের আনাগোনা খুব। প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ আসে।

এবার একটু পেছন ফিরে যাই। ঠিক ১০০ বছর পেছনে। তখনও একজন এসেছিলেন। আমাদের মতো দলবেঁধে নয়, একদম একা। এক মহা সাধক। কিংবদন্তি তপস্বী। থেকেছেন একনাগাড়ে ১২ বছর। আজকালকার দিনেও এ পথে আসতে গা-চমচম অবস্থা। একলা আসতে কেউ তেমন একটা সাহস করে না৷ তাই দলবেঁধে আসে। কারণ, এ এক ঐতিহাসিক স্থান। সে ইতিহাস ১০০ বছরের পুরোনো। সে সময়কার কথাটা ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। ইউটিউবে দেখা ব্রাজিলের আমাজন ও আফ্রিকার গহীন জঙ্গল চোখের সামনে ভেসে উঠছে। শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠলো। না-ছিল জনমানব, না-ছিল পথঘাট, না-ছিল খাবারদাবারের ব্যবস্থা। কীভাবে, কেন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর? 

নিজের মনকে প্রশ্ন করতেই এর কারণ বলে দিল। এর আগে শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জে শকরের কাহিনী পড়েছিলাম। তিন বারো ৩৬ বছরের নাগাতার সাধনার গল্প। বড়োপীর আবদুল কাদের জিলানি করেছেন ৪০ বছর। আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হেরা গুহায় কাটিয়েছেন বহু বছর। এভাবে আরো বহু উদাহরণ আছে। সবই তপস্যাধারী সম্রাটের গল্প। একাগ্রে নির্জন বনবাদাড়ে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। সেখানে থেকে কঠোর সাধনার মাধ্যমে খুঁজেছেন পরম স্রষ্টাকে।

এবার সে মহাপুরুষের পরিচয় দেবার পালা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বিখ্যাত সুফিসাধক মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রবর্তক হজরত কেবলা আহমদ উল্লাহ (ক.) এর ভাইপো। লোকে বলে ‘বাবা-ভাণ্ডারী’। মূল নাম ‘গোলামুর রহমান’। মাইজভাণ্ডার গ্রামে আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর মাজারের কাছেই তাঁর মাজার অবস্থিত। তিনিই ঘরবাড়ি ছেড়ে রাঙ্গামাটির এ গহীন জঙ্গলে এসেছিলেন সাধনার লক্ষ্যে। কাটিয়ে গেছেন এক যুগ। 

পরিচিতি পাওয়া গেল। এবার গুহায় ফিরে আসি। গুহা না-বলে ভজনালয় বলি। ভজন মানে সাধনা, ইবাদত। ভজনালয় মানে সাধনার ঘর। সেই দ্বিতীয় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছি। বেলাল ভাই মিলাদের সুর ধরেছে,
“সালাতুন ইয়া রাসুলাল্লাহ আলাইকুম
সালামুন ইয়া হাবিবাল্লাহ আলাইকুম।”
আমরাও পড়ছি। আমরা ছয়জন ছাড়া অচেনা আরো বারোজন এসে যুক্ত হলো। মিলাদ শেষ পর্যায়ে। জিয়া ভাই গান ধরেছে। বড়ো মোহনীয় গান। বড়ো অভিমানী সুর।
“নাম ধরেছো রহমান, দয়ার সীমা নাই,
খালি হাতে কেউ ফিরে না তোমার কাছে যায়,
আমার বেলায় দয়াদানে হও কেন কৃপণ,
প্রেমাগুনে জ্বালাই মারো সারাটি জীবন।”

লেখক পরিচিতি:
মুহাম্মদ সৈয়দুল হক
চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম।
সম্মান দ্বিতীয় বর্ষ, বাংলা বিভাগ।
মোবাইল: 01837127170
Email: saidulhoque060@gmail.com

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...