সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শির্কের আড্ডাখানা ৫

শির্কের আড্ডাখানায় একদিন (পর্ব-৫)

মাথা কোনোমতে বাঁচা গেল। কিন্তু পরাণ যায়-যায় অবস্থা। একটা ভুলকে আঁকড়ে বেঁচেছি এতকাল? এ নিয়ে কতো বাড়াবাড়ি-ই না করলাম। না না, আমার-ই বোধয় ভুল হচ্ছে। নিশ্চয় এর ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকতে পারে।
—এখানটাই বসুন।
—জী? ওহ হ্যাঁ, বসছি। ভিন্নজগতে চলে গেছিলাম। খাদেমের বসতে বলায় হুশ এলো।
—আপনার কি শরীর খারাপ?
—জী না, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো হঠাৎ।
—আপনাকে বেশ বিব্রত মনে হচ্ছে। এই নিন, পানি খান। 
মুহূর্তেই ডগডগ করে গিলে ফেললাম। লম্বা করে একটা নিশ্বাস। ভেতরে বায়ুর ঘাটতি ছিল। পুষিয়ে নিলাম। প্রাণটা ফিরে এলো।
—আপনি কি খেয়েছেন? খাদেমের প্রশ্ন।
—না, খাওয়া হয় নি এখনও। আসুন, মহিষের গোশত দিয়ে বিরানি রান্না হয়েছে। দুজনে একসাথে খাই। ভালো লাগবে।

পেটে ক্ষুধা ছিল। ভদ্রতার খাতিরে না করলে না-খেয়ে মরা লাগবে। আগাতে গিয়ে থেমে গেলাম। চাচা, শুনুন—
—জী, বলুন।
—আমি খাবো না, আপনি যান।
—হঠাৎ সিদ্ধান্ত চেঞ্জ। কারণ?
—আপনারা পীরের নামে জবাই দেন। ওগুলো খাওয়া যায় না, হারাম। মলতুল্য।
—এ কথা কে বললো? (ঈষৎ হাসি)
—জানি আমি, শুনছি। শফি সাব হুজুর বলেছেন।
—ঐ যে, কাকটা দেখেছেন? আপনার কান নিয়ে পালাচ্ছে। ধরুন ওটাকে।
কানে হাত দিলাম। কানের জায়গায় কান ঠিক-ই আছে। রাগ হলো। খাদেমকে হালকা ঝাড়ি দিলাম—ফাজলামো করেন আমার সাথে? তিনি চমকালেন না। সহাস্যে জবাব দিলেন–
আপনি লোকটা বেশ চালাক। আমার কথায় বিশ্বাস না-করে কান হাতিয়ে দেখলেন। কাকের পিছে দৌড় মারেন নি। আপনি আবার বোকাও। শফি সাবের কথায় কাকের পেছনে দৌড়াচ্ছেন বহুকাল। শুনুন, শোনা কথায় কান দিলে বিপদ। বিকেলে আবার জবাই হবে। স্বচক্ষে দেখে যাবেন। এখন আসুন। 
—আগে আপনাদের জবাই-পদ্ধতি বলুন।
—উত্তর-দক্ষিণ করে শুইয়ে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর।
—আল্লাহর নামে? আমাদের মত?
—বিশ্বাস করে নিতে পারেন। যাচাইয়ের সুযোগ তো বিকেলে থাকছেই। আসুন।

আরেকটা বিশ্বাসের পতন। আমার বিশ্বাসগুলো একের-পর-এক ধুমছেমুছড়ে যাচ্ছে। কেন যে এখানে এলাম। খাদেম সাহেব মাদুর পেতে বসতে দিলেন। এভাবে খাওয়া হয়নি বহুকাল যাবৎ। হাত-পা জড়ো করে কোনোমতে বসলাম। গরমগরম মহিষের বিরানি সার্ভ করা হলো। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। 

যাক, খাদেমের উসিলায় পেটপূজাটা হলো কোনোরকম। এই যা, আবার উসিলা।
—কী জনাব, খাবার ভালো হয়েছে তো?
—খেতে খেতে অস্পষ্ট-স্বরে জবাব দিলাম—বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে। তা, একটা প্রশ্ন ছিল জনাব।
—উসিলা?
—আপনি কীভাবে বুঝলেন?
—তা ছাড়ুন। বলুন, কী জানতে চান?
—না মানে উসিলা ব্যাপারটাকে আপনারা কীভাবে দেখেন। এর যৌক্তিকতা কী? আল্লাহর কাছে কি সরাসরি চাওয়া যায় না?
—কোথা থেকে এসছেন?
—এটার সাথে উসিলার সম্পর্ক?
—বলুন না।
—চট্টগ্রাম শহর থেকে।
—কীসে করে?
—বাসে।
—সে কী, আল্লাহকে বললেই তো হতো। হাওয়ায় ভাসিয়ে এনে দিত। বাসের মাধ্যমে আসার কী দরকার ছিল? ও হ্যাঁ, হাওয়ায় ভেসে আসলে কিন্তু হাওয়াটাই উসিলা হয়ে যাচ্ছে। 
—কী-সব আবুল তাবুল বকছেন?
—দেখুন, সামান্য শহর থেকে এখানটাই আসতে বাসকে মাধ্যমে বানাতে হলো। আল্লাহর আলিশান দরবারে দুআ পাঠাতে মাধ্যম লাগবে না? একটু আগে পানি খেলেন গ্লাসের মাধ্যমে। পাতালপুরীতে ঠোঁট লাগিয়ে নিশ্চয় খাননি? সে পানি আবার উপরে উঠেছে কলের মাধ্যমে। সে কল বানানো হয়েছে আবার লোহার মাধ্যমে। সে লোহা আবার...
—থামুন, কী বলতে চাচ্ছেন?
—বলতে চাচ্ছি আপনি ভাত খাচ্ছেন হাতের মাধ্যমে। আপনাআপনি পেটে যাচ্ছে না। জিহ্বায় নাড়াতে হচ্ছে। দাঁতে চিবুতে হচ্ছে। পেটে যাচ্ছে গলার মাধ্যমে। সেখানে গিয়ে হজম হচ্ছে পরিপাাকতন্ত্রের মাধ্যমে। বড়ো বড়ো করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন চোখের মাধ্যমে। বকবকানিগুলো শুনছেন কানের মাধ্যমে। সর্বোপরি আপনি পুরো মানুষটা দুনিয়ায় আসছেন আপনার মা-বাবার মাধ্যমে।
—যুক্তির কথা ছাড়ুন। কুরআন হাদিস থেকে কিছু বলুন।
—কুরআন হাদিস থেকে আর কী-ই বা বলি। উসিলা না-হলে তো কুরআন হাদিসের কোনোটাই আমরা পেতাম না।
—মানে?
—জিবরাইল আ.কে চেনেন?
—ফেরেশতা-প্রধান।
—জী হাঁ, কুরআন নিয়ে হেরা গুহায় তিনিই প্রথম এসেছেন। প্রথম ওহি সরাসরি নবির কাছে আসে নি। মাঝে মাধ্যম ছিলো৷ মাধ্যমের নাম জিবরাইল। কুরআনের অধিকাংশ আয়াত মাধ্যম মেনে এসেছে৷ আল্লাহ চায়লে ডিরেক্ট দিতে পারেন। কিছু অংশ সেভাবে দিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছেন। তবে তিনি ওসিলাকে পছন্দ করেছেন। তাই তিনি সবকিছুতে একটা উচিলা ফিট করেছেন৷ কেন? এ প্রশ্নের চরম মজার উত্তর আছে। আজ ‘হেকমত’ বলে শেষ করি।

সায়িদ বিন সাবিতের কাছে আসি৷ তিনি প্রধান ওহিলেখক। কুরআনের বাণীগুলো লিখে রাখতেন। তার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি। না-লিখলে? পেতাম না। না-পেলে? আল্লাহ হেফাজতকারী!

হাদিসের হিসাবও একই। ওসিলা মেনে পেয়েছি। প্রথমে সাহাবি। তারপর তাবেয়ি, তবে তাবেয়ি, আয়িম্মা—বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ... এই যে সিলসিলা। আমাদের দোরগোড়ায় ইসলাম পৌঁছে দিয়েছে। মাধ্যমের কারণে ইসলাম পেয়েছি। ইসলামে মাধ্যম অনিবার্য। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...