সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শির্কের আড্ডাখানা ৬

শির্কের আড্ডাখানায় একদিন (৬)

খাওয়া শেষ। যুক্তির কথা বাদ দিই। একদিকে কুরআনে আল্লাহর নির্দেশ, অপরদিকে হাদিসের স্পষ্ট নস। আর মুখ ফুটানোর সাহস হলো না। হাত-মুখ ধুয়ে আবার দাঁড়ালাম৷ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীর কবরের সামনে। দেয়ালে আরও কিছু লেখা। একটা একটা পড়ার চেষ্টা করছি।

“তুমি যখনই আমার প্রতি তাকাও, আগ্রহান্বিত হও, আগাইয়া আসো, আমি মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী—তোমার জন্য দুআ করি। আর যখন বিমুখ হও-পেছনে তাকাও, আমি তোমার জন্য কাঁদি। যেহেতু পশ্চাৎ দিক থেকে কোনোকিছু দেওয়া ও নেওয়ার নিয়ম নাই।” —পীরানা পীর আবদুল কাদের জিলানী...

পেছন দিক থেকে আসলেই দেয়া-নেয়া যায় না। সামনে যেতে হয়। চায়তে হয়। লেনদেনে  ভাবের আদান-প্রদান লাগে। না-হলে হয় না। ব্যাপারটা দারুণ। হৃদয়ে গেঁথে রাখার মত। আগানো যাক।

“তুমি সম্মুখে থাকিয়া যদি স্মরণে বিচ্যুত হও, তবে তুমি ইয়ামেন দেশে। আর যদি ইয়ামেনে থেকেও স্মরণে বিচ্যুত না-হও, তবে তুমি আমার সম্মুখেই।” —গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.)।

জ্ঞানগর্ব কথা। প্রেমাস্পদের অব্যক্ত শব্দমালা। ব্যাপারটাতে প্রবল প্রীতির গন্ধ আছে। কথাগুলো আমাকে মোহিত করে চলেছে। অজানা মোহে পড়ে যেতে লাগলাম। সৈয়দ মাওলানা আহমদ উল্লাহ (ক.)’র আরেকটি বাণী পাশাপাশি লেখা—
“যে কেহ আমার সাহায্য প্রার্থনা করিবে, তাহাকে আমি উন্মুক্ত সাহায্য করিব। আমার গাউছিয়ত সরকারের এ প্রকৃতি হাসর-তক জারী থাকিবে।”

নাহ, এ কথাটি গিলতে পারলাম না। মাথার উপর দিয়ে গেল। ওলিদের বিশেষ মর্যাদার কথা জানা ছিল। তা বলে ‘উন্মুক্ত সাহায্য’র ক্ষমতা? তাও আবার হাসর অবদি। থাকতে পারে না। এ ক্ষমতা আল্লাহর। বাক্যটাতে শির্কের গন্ধ স্পষ্ট। ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো পরের বাক্য—
“আমি হাসরের দিন প্রথম বলিব লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ।”

পড়লাম দুটানাই। উপরের বাক্যে শির্ক, নিচের বাক্যে তাওহিদ। অথচ দুটা পাশাপাশি আসতে পারে না কখনও। এদের অবস্থান দু’মেরুতে। বুঝলাম না; যে, খোদার ক্ষমতা নিয়ে টানছে, কিয়ামতের দিন তার প্রথম কথাটি হবে—‘আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নাই’। মাথা চক্কর দিচ্ছে। একেকবার একেক রূপের কথা দেখি। নিজের নীতি-বিশ্বাসের সাথে কখনও সবকিছু মিলে যাচ্ছে, আবার কখনও মাথায় হিমালয় পর্বত চড়ে বসছে। কী হচ্ছে এসব। এখানে এত রঙ কেন? সবকিছু যেন অন্ধকার। দোদুল্যমান অবস্থায় পড়লাম। পরে কী আছে দেখি—

“নিজের হাতে পাকাইয়া খাও, পরের হাতে পাকানো খাইও না। আমি বারোমাস রোজা রাখি, তুমিও রাখিও।”

নামাজ তো দেখেছি। সে বিশাল জামাআত। এখন দেখছি রোজার তালিমও আছে। তাও বারোমাস! আর ঐ কথাটা—নিজহাতে পাকাইয়া খাও, পরের পাকানো খাইয়ো না। পরনির্ভরশীলতা পরিহারের অনুপম শিক্ষা। নাহ, এখানে পা দেবার পর থেকেই কী-সব আজব কাজকারবার দেখে চলেছি। কখনও পরিষ্কার মুক্তির কথা, কখনও আবার ভ্রান্তির বেড়াজালে আঁটকে যাচ্ছি। অদ্ভুত নিয়ম-কানুন আর অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা ঘিরে ধরছে মাঝেমাঝে। লাস্টমাথা কী যেন একটা লেখা আছে—

“প্রবৃত্তি নিবৃত্তি ভবে—জানো তিনভাবে
বাক-বিতণ্ডা পরিহারে—জানার আগ্রহে
পরদোষ পরিহারে—নিজ দোষ ধ্যানে।
সুধাইনু সুধিজনে সুধির ভাষণে
না-দেখাইবে পীর যাকে এই তিন ধারা
আসিবে না সোজাপথে, সে পথহারা।”
—অছিয়ে গাউছুল আজম সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী। 

কঠিন ভাষায় সহজ কথা৷ যা বুঝলাম— প্রবৃত্তির নিবৃত্তি। মানে পার্থিব আকাঙ্ক্ষার অবসান। সোজা কথায় দুনিয়াপ্রীতি বিমুখ হওয়া। বাক-বিতণ্ডার বর্জন। মানে অহেতুক বাড়াবাড়িতে না-যাওয়া। জানার আগ্রহে পরদোষ পরিহার। মানে পরচর্চা তথা গিবত-চোগলখোরী ত্যাগ করা। নিজদোষ ধ্যানে। নিজের দোষ-দুর্বলতার সন্ধান করা।

বাহ! দারুণ তো! পীরেরা কি আসলে এগুলোই শেখায়? নিচে লেখা আছে—এসবের সবক না-দিলে সে পথহারা হিশেবে বিবেচ্য। আমি তো জানি, পীর-মুরিদি একটা ব্যবসা। মুরিদরা অন্ধের মত পীরের আনুগত্য করে। অযথা পীরের পেট ভরায়। কিন্তু এখানে এ বিষয়টিও উল্টো দেখছি। দারুণ শিক্ষা দেয়ার কথা আছে মুরিদকে। কী-জানি, পীরেরা এসব শিক্ষা দেয় না-কি পেটপূজা করে!

অন্তরে কিছুটা সংশয়, কিছু প্রশস্তি। মনে নানান প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি। খাদেমকে বিদায় জানিয় বের হয়ে গেলাম। পশ্চিম দিকে কয়েক কদম হেঁটে ডানে মাথা ঘুরাতেই দেখি আকাশে কুরআন ভাসছে...

চলবে...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...