সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

উপন্যাস-২

শিশুনবি আমেনা মায়ের কোলে। হাত-পা নেড়ে নেড়ে খেলছে। পাড়াপড়শি একে একে আসতে লাগলো। আমেনার কোলে নাকি চাঁদ এসেছে। তার উপর আবদুল মোত্তালিবের নাতি বলে কথা। পুরো কুরাইশ গোত্রে তার মতো প্রভাবশালী আর কে আছে? অপরদিকে বাবা আবদুল্লাহ ইনতেকাল করেছে মাত্র ক’মাস হলো। বেচারা ছেলের মুখটাও দেখতে পায়নি। সে থাকলে নির্ঘাত সারা মক্কায় ঘোড়ায় করে ছেলে হওয়ার খবর ছড়াতে থাকতো। সবমিলিয়ে শিশুনবিকে একনজর দেখার জন্যে আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আবদুল্লাহর বাড়িতে ভিড় জমাতে লাগলো।

দাদা আবদুল মোত্তালিব দুধ-মাতা খোঁজে ক্লান্ত। আরবে দুধ-মাতার প্রচলন ছিল৷ শহুরে সন্তানদের পাঠানো হতো গ্রামাঞ্চলে। সেখানকার মহিলারা নবজাতকদের দুধপান করাতেন। বিনিময়ে পেতেন অর্থকড়ি। তা দিয়ে চলতো সংসার।

পারস্যে দুর্ভিক্ষ চলছিলো। নবজাতকের সন্ধানে একদল মহিলা মক্কায় এলো। সবার ভাগ্যে নবজাতক জুটলেও একজনের জুটেনি। তিনি সা’দ গোত্রের হালিমাতুস সাদিয়া। তাঁর জন্য পড়ে আছে এক এতিম শিশু; যাঁকে নিতে অন্যান্যদেন মতো ইতোমধ্যে সেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। অবস্থা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষ্যাপা সন্যাসী’র মতো। ক্ষ্যাপা হাতে শিকল নিয়ে পরশপাথর খোঁজে বেড়াতো। খুঁজতে খুঁজতে বৃদ্ধ হয়, ত্বক ফেকাসে হয়, পরশপাথর আর পাওয়া হয় না। একদিন লোকের প্রশ্ন শোনে সে চমকে ওঠে। এ কী ক্ষ্যাপা, তোমার হাতে স্বর্ণের শিকল এল কোথা থেকে? ক্ষ্যাপা তো অবাক! হাতে তো লোহার শিকল ছিল। স্বর্ণ হলো কী করে? হায়রে ক্ষ্যাপা, কোথায়-কখন যে এ শিকল পরশপাথরে লেগে স্বর্ণ হয়ে গেছে—সে নিজেই বুঝতে পারেনি! কারণ, সে পরশপাথর খোঁজে মরেছে ঠিকই, আদতে পরশপাথর কীরূপ তা তার জানা ছিল না।
কেবলি অভ্যাসমত      নুড়ি কুড়াইত কত,
        ঠন্‌ ক'রে ঠেকাইত শিকলের 'পর,
চেয়ে দেখিত না নুড়ি, দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,
       কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশ-পাথর।

এ মহিলারা এসেছে ভাগ্যবিড়ম্বনায় ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেখতে। অথচ নিজেরাই জানে না—কোন শিশুটির মাঝে কী লুকিয়ে আছে। ক্ষাপার ভাগ্য খারাপ হলেও হালিমার ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। না-চিনে ফেলে আসা পরশপাথর সে পুনরায় কুড়িয়ে পেল। স্বামীর সাথে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়—এতিম শিশুটিকেই নেবে। আমেনা তাঁর দুলালকে হালিমার হাতে সোপর্দ করতে করতে বলে—“যেমন তেমন ভেবো না। এ ছেলে গর্ভে থাকতে আমি কখনও গর্ভানুভূতিই পাইনি। গর্ভাবস্তায় যে-সব স্বপ্ন আমাকে দেখানো হয়েছে, তা শুনলে অবাক না-হয়ে পারবে না। জন্মের সময় তাঁর খৎনা করানো ছিল।”

পরশপাথর হালিমার কোলে। হালিমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল। দুর্ভিক্ষের কারণে তার স্বাস্থ্য খারাপ যাচ্ছিলো। বুকে দুধ ছিল না। নবজাতককে কোলে নিতেই স্তন দুধে ভরে ওঠলো। তাঁর জীর্ণশীর্ণ গাধাটিতে চেপে বসতেই তার শক্তি আর গতি বেড়ে গেল। দুধপান করাতে গিয়ে ঘটে আরেক কাণ্ড। নবজাতক এক স্তন থেকে পান করে। অন্যটি ছোঁয় না। একই ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে। হালিমার মনে প্রশ্ন জাগে—তারও এক সন্তান আছে। তার জন্যেই কি সে অন্যটি রেখে দেয়? আহ, শিশুনবির ইনসাফ! তাঁর বসতির আশপাশ ছিল বেজায় শুষ্ক আর অনুর্বর। ইতোমধ্যে তা সবুজ লতাপাতা আর ঘাসে ভরে ওঠলো। পাথর ফেটেও যেন উদ্ভিদ জন্মাবে! হালিমার পশুগুলো দিনদিন মোটাতাজা হতে থাকে। সেগুলির স্তন দুধে পূর্ণতা পায়। হালিমা নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে বিক্রিতে মন দেয়। লাভবান হতে থাকে দিনদিন।

দেখতে দেখতে শিশুনবি দুবছরে পৌঁছয়। এ দুবছর চুপচাপই থাকা হলো। কিন্তু আর কত? এবার না-হয় একটু কথাবার্তা হোক। তাঁর সুমধুর কণ্ঠ পৃথিবী একটু শুনুক। কিন্তু কী বলে শুরু করা যায়? কোন শব্দে শুরু করলে শুরুটা ঠিক শুরুর মতো হয়? হ্যাঁ, এটা তাঁর বেশ জানা। আগেও কোথায় যেন করেছিলেন। ও হ্যাঁ, সেই নুরানি জগতে। দুনিয়াতেও সেই স্রষ্টার প্রশংসা দিয়ে শুরু করলেন—
“আল্লাহু আকবর কাবিরা, ওয়ালহামদু লিল্লাহি কাসিরা,
ওয়া সুবহানাল্লাহি বুকরাতাও ওয়া আসিলা।”
“আল্লাহ অসীম সবচে মহান প্রশংসা সব হয় যে তাঁর,
সকাল-সন্ধ্যা জিকির মুখে—নির্মল নেই সত্তা আর।” বাহ! হোয়াট অ্যা স্টার্ট!

বাচ্চা বয়স। তবু খেলাধুলায় ঝোঁক নাই। অন্যান্য বাচ্চারা খেলায় মাতে। তিনি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন। মাঝে মাঝে একাকী নির্জনে বসে কী যেন ভাবে! কারে যেন খোঁজে! গাছগাছড়া, লতাপাতার সাথে কথা বলে। মেঘের সাথে হাঁটে। চাঁদের সাথে খেলে।
“কে জানে কাহার সাথে কয় সে কথা দূর নিরালায়,
কে জানে কাহার খোঁজে যায় পালিয়ে বনের সীমায়!
কভু সে       শিশুর মত,
কভু সে       ধেয়ান-রত।” —নজরুল
দুধভাই আবদুল্লাহ, দুধবোন আনিসা-হাফিজা তাঁকে নিয়ে ঘুরতে যায়। ছাগল দৌঁড়য়, মেষ চড়ায়। দেখতে দেখতে বয়স চারে পৌঁছয়। রীতিমতো মাঠে যায় মেষ চড়ানোর বাহানায়। একদিন কোথা থেকে সাদা পোশাকধারী দুই ব্যক্তি এলেন। (মূলত তাঁরা ফেরেশতা। এসেছে মানুষরূপে। বুঝা যায়—মানুষরূপ ধারণ করলেই সবাই মানুষ হয়ে যায় না।) তারা তাঁকে শুইয়ে দিলেন। বুক ছিঁড়ে কলব বের করে আনলেন। তা থেকে কালো জাতীয় কিছু একটা ফেলে দিলেন। কলবকে স্বর্ণের পাত্রে রেখে জান্নাতি বরফে ধুলেন। অতঃপর যথাস্থানে লাগিয়ে বুকে হাত মালিশ করতেই বুক পূর্বের অবস্থা ফিরে পেল। অপারেশন সাকসেসফুল! এর নাম ‘শাককে সদর’—বক্ষবিদারণ। এটা কেন? ঘন মেঘ উজ্জ্বল সূর্যের আলোকেও আঁটকে দেয়। পানির সংস্পর্শে নিরেট লোহাতেও জং ধরে। ঠিক সময়ে পরগাছা ছেঁটে না-ফেললে হৃষ্টপুষ্ট বৃক্ষকেও গ্রাস করে। এ জগৎ বড় পঙ্কিলতায় পূর্ণ। থরে-বিথরে শয়তানি কলুষতায় ভরা। হাকিকতের মুহাম্মদ তো আর আপনরূপে পৃথিবীতে আসেনি। এসেছেন মানবরূপে। মানবীয় গুণ ধারণ করে। নুরি দেহ ধুলির পৃথিবীর সংস্পর্শে এসে তাঁর ফল খেয়েছে, জল পান করেছে। অতএব কলবে ধুলির বিশেষত্ব স্থান করে নেয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাঁর আলোয় জগৎ আলোকিত হবে, যাঁর স্পর্শে মাটির মানুষ সোনালি বরণ ধারণ করবে—সে পরশপাথরের অস্তিত্বে তো দুর্বলতা স্থান নিতে পারে না। অতএব, জায়গা করে নেয়া অবশিষ্টটুকু পরিষ্কার করা চাই। ধুয়ে-মুছে পাকসাফ করা চাই। এ কারণেই এ বক্ষবিদারণ। যা পরবর্তীতে আরও তিনবার হয়েছিল। এ এক মহান লীলা। স্রষ্টার বৈচিত্র্যপূর্ণ খেলা। সবটা বুঝতে যেতে নেই।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...