সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

উপন্যাস-৩

কৃপাসিন্ধু-৩

নবিজির বয়স ছয়। শিশুকালের সমাপ্তিলগ্ন। মায়ের ছেলে এবার মায়ের কোলে ফিরবে। হালিমার ভাগ্যে ফের পরিবর্তনের আবাস। কেঁদে কেঁদে দিন যায়, রাত কাটে ভাবনায়। পেটে ধরেনি তাতে কী, বুকে তো ধরেছে। পিঠে চড়িয়েছে। হাতে তোলে খাইয়েছে। নজরে নজরে রেখেছে। সোহাগে ভরিয়েছে। নিজের ছেলে কি পরের ছেলে—তফাৎ করে দেখেনি। তবু উপায় নেই। নদীর স্রোত আপন গতিতেই চলে। কিছু সময় আঁটকানো গেলেও ধরে রাখা যায় না। জীবন একটা বহতা নদী। তাকে কে আঁটকায়? যাঁর গন্তব্য সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে, তাঁকে আঁটকানোও সম্ভব না। দুধভাই আবদুল্লাহ, দুধবোন আনিসা-হাফিজা কেঁদে কেঁদে হয়রান। তাদের ভাইকে তারা কিছুতেই যেতে দেবে না।

মক্কার পথে হালিমা। বুকের ধনকে গর্ভধারিণীর কাছে সমর্পণ করতে যাচ্ছে। পা চলে না, ভারী ভারী ঠেকে; তবু জোর করে চালায়। চোখের জল চলার পথে নদী বয়ে দেয়। এদিকে আমেনা পথ চেয়ে বসে আছে কবে থেকেই। হাজার রাজার ধন ফিরবে বলে কথা। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে  চিত্ত ব্যাকুল। এক দুই করে প্রহর গুনছে। চাতক যেরূপ বৃষ্টির জন্য গুনে। মানুষ যেরূপ ২৯ রমজান সন্ধ্যার আকাশে ঈদের চাঁদ খোঁজে ফেরে, সেরূপ সন্ধানী-চোখে সিরিয়ার পথে তাকিয়ে তিনি। কিন্তু সে যতই সন্ধানী চোখ হোক না কেন, মেঘের ঘনঘটা থাকলে চাঁদের নাগাল আর পাওয়া যায় না। সিরিয়ার পথে হঠাৎ মেঘের লুকোচুরি। আমেনা তাকিয়ে দেখে হালিমা আসছে; কিন্তু তাঁর দুলাল নেই।

দৌড়াতে দৌড়াতে হালিমার আগমন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে—আমি আপনার দুলালকে হারিয়ে ফেলেছি। ঐ যে, শহরের ভীড়ের মাঝে। আমেনার মাথায় যেন সব আসমান একসাথে ভেঙে পড়ল। মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। অধিক শোকে পাথর! দাদা আবদুল মুত্তালিব কাবার সামনে গিয়ে সিজদায় লুটে পড়ে। দীর্ঘক্ষণ পর সিজদা থেকে মাথা তোলে। তারপর যা দেখে তাতে তাঁর অবস্থা—তাতাথৈথৈ! ওয়ারাকা তাঁর নাতিকে নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওয়ারাকার পরিচয় পরে জানা যাবে। আগে আবদুল মুত্তালিবের লে-চুট দেখে নিই।

নাতিকে একটানে ঘাড়ে তোলে নেয়। শুরু করলেন দৌড়ানো। কাবার চারিদিকে ঘুরছে আর ঘুরছে। মকবুল হজ বোধয় ঐদিনই করে ফেলেছিলেন তিনি। দৌড়ানো থামে বেশ কিছুক্ষণ পর। শুরু করলেন দান করা। দানের কী আর শেষ আছে। উট, ঘোড়া, ভেড়া—যা যা সামনে পাচ্ছে দুহাতে দিয়ে দিচ্ছে। হালিমাকে পুরস্কৃত করল হিসেবনিকেশ ছাড়াই।

আমেনা ছুটতে ছুটতে শ্বশুরের কাছে পৌঁছয়। আবদুল মুত্তালিব মায়ের সন্তানকে মায়ের বুকে তোলে দেয়। কিছুক্ষণ আগেই আমেনার চেহেরাজুড়ে মেঘ জমেছিল। এবার বৃষ্টি নামাবার পালা। আর দেরি কেন, চোখ দুটো এবার ইচ্ছেমতো ঝড়াক না আনন্দাশ্রু। বুকজুড়ে সাহারার লু-হাওয়া বইছিলো এতক্ষণ। সেখানে এবার বান ডেকেছে। সে বানে আমেনা একা না, গোত্রের সব নারি-পুরুষ, শিশু-কিশোর মিলেমিশে একত্রে সাঁতরালো। কিন্তু আরবের বৃষ্টি আর বান বলে কথা। বেশিক্ষণ স্থায়ী হবার জো নেই। বাদল টুটে গেছে। মেঘের কোলে রোদের ঝিলিক। গোত্রজুড়ে আনন্দের বোল ফুলেছে। আমেনা ছেলেকে বুক থেকে সরাতে ভুলে যায়। উৎসব চললো বেশ কিছুদিন।

সে উৎসবের হাওয়া এবার মক্কা ছেড়ে মদিনার পথে। মদিনার আদি বিন নাজ্জার গোত্রে। সেখানটায় নবিজির মামার বাড়ি।মামার বাড়ি নাকি মধুর হাঁড়ি। অথচ এখনও নবিজির সাথে পরিচয়-ই ঘটেনি।  তা ছাড়া ভবিষ্যতের স্থায়ী-নিবাসকে পর্যবেক্ষণও করা যাক এ-ফাঁকে। সেখানকার আলো-বাতাসকে পরখ করাও হয়ে যাক। আমেনা পুত্রকে নিয়ে মক্কার মরু, তরু অতিক্রম করে মদিনায় চললেন।

মদিনার পরিবেশ মক্কার চেয়ে অনুকূলে। মক্কার তীব্র গরমের তুলনায় তাপমাত্রা অনেকাংশে কম। রীতিমতো উত্তরি-বায়ুর আনাগোনা। শ্যামলিমা খেজুর বাগান। চিরহরিৎ ঝাউগাছ। তার ফাঁকে হুদহুদ-পায়রাদের গান। বিস্তৃত মরু-অঞ্চলের কোথাও কোথাও বয়ে চলেছে সরু খাল৷ বাড়ি-ঘরের আশপাশে ছোটছোট পুকুরে ভরা। সেখানটায় লোনামাছের চাষ। সে পুকুরে নবিজি সাতার কাটে। খেলা করে মাছের সাথে। খেজুরের ছায়ায় বসে পাখিদের গান শুনতে শুনতে দিন কাটে। এভাবে চললো প্রায় মাস খানিক৷ এবার বিদায়ের পালা। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমেনার যাত্রা শুরু।

আসতে আসতে ‘আবওয়া’য় পৌঁছলেন। এটি মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী স্থান। আমেনা হঠাৎ অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শরীরের অবস্থা খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাথী উম্মে আয়মন সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকে। শিশুনবি মায়ের সেবায় নিজের খাওয়া-দাওয়া ভুলে যায়। কিন্তু কিছুতেই অবস্থার উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। সূর্যে ডুবে ডুবে ভাব। তার চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আমেনা বুঝতে পারে তাঁর বেলা ফুরিয়ে এসেছে। সময় বেশি নেই। ছেলেকে শিয়রের কাছে ডাকে। তাঁর কণ্ঠবেয়ে অমৃতবাণী ঝড়তে থাকে—“বাচাধন, শোনো আমায়। প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর দিকে ধাবিত। নতুন বস্তুগুলো একদিন পুরোনো হয়। বৃদ্ধরাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেরূপ আমিও বিদায়-পথযাত্রী৷ তবে সান্ত্বনা এই—আমি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবো। কারণ, আমি তোমাকে কল্যাণকারী-রূপে রেখে যাচ্ছি। যেরূপ তোমাকে পূতপবিত্র অবস্থায় জন্ম দিয়েছিলাম।” আমেনার কথা অর্ধেকেই থেমে গেল। চোখ পলকের মাঝামাঝি আঁটকে গেল। তার হাত নবিজির পিঠ থেকে আপনাআপনি পড়ে গেল। নাক দিয়ে বায়ুর প্রবাহ থেমে গেল৷ হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক  থমকে গেল। অদৃশ্য থেকে বিলাপের সুর আসতে লাগলো—
“হায় আমেনা! মর্যাদাময় পুণ্যবতী
রূপবতী-সতীসাধ্বী,
শেষ জামানার নবির মাতা,
তোমার লাগি মোরা কাঁদি।”

এই বিজন মরুর মাঝে নবিজিকে রেখে মা স্বর্গের পথ ধরেছেন। দুনিয়ায় আসার আগেই বিদায় নিয়েছেন বাবা আবদুল্লাহ। যিনি সবার জন্যে, তিনিই আজ সর্বহারা! সবকিছুই তাঁর, অথচ কোথাও কেউ নেই! উৎকৃষ্ট তরবারি বানাতে লোহাকে উৎকৃষ্টভাবেই পুড়াতে হয়। মরুঝড়ে যে খেজুর গাছটি টিকে যায়, সে-ই ফল দেয়। এ-তো সবে শুরু। খোদায়ী কামারশালায় তাঁকে আরও কতভাবে যে দগ্ধ করা হবে, সে চিত্র দেখতে সামনে আগানো যাক...

নবিজি কৈশোরে। দাদা আবদুল মুত্তালিবের সোহাগেই কাটতে থাকে দিন। বয়স একশ পেরুনো আবদুল মুত্তালিবের আসন ছিল কাবার পাশাপাশি স্থানে। সে আসনে নিজ ছেলে-মেয়েদের বসার সুযোগ না-দিলেও কিশোর মুহাম্মদের জন্য তা বরাদ্দ। অবস্থা এমন ছিল যে, কিশোর মুহাম্মদের সন্তুষ্টিই আবদুল মুত্তালিবের সন্তুষ্টি। কিন্তু যিনি পুরো পৃথিবীকে ছায়া দেবেন, তাঁর উপর আবদুল মুত্তালিবের ছায়াকেও দীর্ঘায়িত করতে চায়লেন না সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী স্রষ্টা। নবিজির জন্মের অষ্টম বছরেই তিনি বিদায় নিলেন। নবিজির দায়িত্ব বর্তায় চাচা আবু তালিবের কাঁধে। সেই আবু তালিব, যিনি নবিজির বারো বছর বয়সে সিরিয়ার পথে বাণিজ্যে যাওয়ার পথে বহিরার মাধ্যমে অনেক অজানাকে জানতে পারেন। বহিরার সাথে কী ঘটেছিল, তা আমাদের জানা। এর পরে যাওয়া যাক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...