জিলকদ মাস চলছে। মক্কার কাছাকাছি উকাজ। সেখানে মেলা বসেছে। কর্তারা নাম দিয়েছে উকাজ-মেলা। মেলা নয়, যেন পাপের আসর। কী হয় না এখানে? মদ, জুয়া, ব্যভিচার, নোংরামি, গালাগালি নাচানাচি, হৈচৈ সব। বেচাকেনা, ঘোড়দৌড়, মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতাও আছে। কিন্তু পুরো মেলার কেন্দ্রে ঐ সাহিত্যের আসর। মেলার মূল আকর্ষণ। কেন্দ্রবিমুখ। আরবের খ্যাতিমান কবি-লেখকরা উপস্থিত। উপস্থিত সম্ভ্রান্ত গোত্র-প্রধানরা। গল্প, কবিতা, আবৃত্তির ও বক্তব্যের বান ছুটছে। যে যার মতো করে প্রতিভার বিকাশ ঘটাচ্ছে। ‘এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ’ অবস্থা। এলো ‘সাবয়া মোয়াল্লাক’ কবিদের কবিতা পাঠের পালা। সাবয়া মোয়াল্লাক মানে ‘ঝুলন্ত সাত’। ইতোপূর্বে উকাজ-মেলায় শ্রেষ্ঠ হওয়া সাত কবিতা। সেগুলো আবার কাবার দেয়ালে ঝোলানো। সোনালি অক্ষরে বাঁধাই করা। তাই এগুলোর মর্যাদা সর্বোচ্চ। কেবল এসব পাঠের জন্য আলাদা ইভেন্ট। সে ইভেন্ট শুরু।
টগবগে এক যুবক। তার কণ্ঠে বজ্রের ধ্বনি। শুরু করলো কবি-সম্রাট ইমরা-উল-কায়েসের কবিতা। কবিতাটি কবির ঘোড়ার বিরত্বে রচিত—
ঊষাকালে যব পাখিরা সবে আপনালয়ে রয় ঘুমে,
তখনি মম ক্ষিপ্র-শিকারি পশমি-অশ্ব যায় ভূমে।
সম্মুখে যেই, পেছনেও সেই, ডানেবাঁয়ে তার এক গতি
চূড়া থেকে পড়া পাথর কিংবা স্রোতের মতই সেই দ্রুতি।
তাকে টেক্কা দিয়ে আরেকজন শুরু করলো। প্রিয়সীর প্রেমে বিভোর আনতারা ইবনে শাদ্দাতের কবিতা—
এভাবে চলছে একের-পর-এক। হঠাৎ খবর এলো ‘উরওয়া’ নিহত হয়েছে। সে হাওয়াজিন গোত্রের লোক। তাকে মেরেছে কিনানা গোত্রের ‘বাররাদ’। মারার পেছনের কারণটা এমন: মক্কার কিছুটা দূরে অবস্থিত ‘হিরা’ রাজ্য। সেখানকার বাদশা নুমান। ব্যবসার উদ্দেশে সে প্রতিবছর উকাজ মেলায় পণ্য পাঠায়। মুদ্রার বিনিময়ে সে-সব নিরাপদে উকাজে পৌঁছায় অন্য একজন। এবার সে দায়িত্ব নেয় উরওয়া। সমস্যা—এই দায়িত্ব নেয়াতে। মক্কার গোত্রগুলি মনে করে—যে অন্যের জান-মালের দায়িত্ব নেয়, সে সম্মানের। তার গোত্র সবার সেরা। ধনে-মানে কুরাইশ ও কিনানা গোত্রের লোকজন অন্যদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে ইতোমধ্যে। তাই তারা মনে করে বহিরাগতদের নিরাপত্তা দিবে কেবল এই দুই গোত্র। উরওয়ার সাথে তাই বাররাদের তর্কে লাগে। বাররাদ বললো, কিনানা গোত্র এখনও বর্তমান। পুচকে হাওয়াজিন গোত্রের লোক এ দুঃসাহস পায় কী করে? উরওয়া বললো, পুরো পৃথিবী তার বিরুদ্ধে গেলেও এ দায়িত্ব নিতে সে প্রস্তুত। শুরু হলো তর্কযুদ্ধ। তর্কে একে-অপরকে ইচ্ছেমতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। একপর্যায়ে বাররাদ সুযোগ বুঝে উরওয়ার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়।
কিনানা গোত্র রক্তপাত ঘটিয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, তাদের উপর আক্রমণ আসবে। মিত্র-গোত্রকে সাহায্য করতে কুরাইশরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো। তারা যতই অপরাধ করুক; বন্ধু বলে কথা। কারণ, আরবদের নীতি হচ্ছে—
“গুণবান যদি পরজন, গুণহীন স্বজন,
তথাপি নির্গুণ স্বজন শ্রেয়, পরঃ পরঃ সদা।”
(মেঘনাদবদ—মাইকেল মধুসূদন দত্ত।)
এদিকে হাওয়াজিন গোত্রের সাথে যোগ দিয়েছে তাদের মিত্র সাকিফ গোত্র। একদিকে কুরাইশ আর কিনানা, অপরদিকে হাওয়াজিন আর সাকিফ। মক্কার কাছাকাছি এসে উভয়ে মুখোমুখি। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। বাঘ আর মহিষের লড়াই। কে আর কারে থামায়। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। এ-দলে দুজন মরে তো ও-দলের চারজন। ও-দলের চারজন মরে তো এ-দলের ছয়জন।
এভাবে চললো দুদিন। ইতোপূর্বে বাসাস যুদ্ধ চলেছিলো চল্লিশ বছর ধরে। না-জানি এটার স্থায়িত্ব কতদিন বা কত বছর! তৃতীয় দিন যুবক মুহাম্মদ পা টিপেটিপে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত। বয়স এখন বিশের কাছাকাছি। সামান্য একটা ঘটনা। অথচ তা থেকে কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সূচনা। দেখে বেশ ক্ষিপ্ত। তবু কাউকে কিছু বলার সুযোগ নেই আপাতত। পুরো গোত্র যুদ্ধ-নেশায় উন্মাদ। চাচারা তাঁকে তাগাড়া দিচ্ছে তীর-বর্শাগুলো সংগ্রহ করতে। পা টিপেটিপে হাঁটছেন, ভাবছেন আর লক্ষ্যচ্যুত হওয়া তীরগুলো সংগ্রহ করছেন। এভাবে শেষ হলো তৃতীয় দিন, যুদ্ধ গড়ালো চতুর্থ দিনে। যুবক মুহাম্মদের পায়ের গুণে নাখলার মাঠ শান্তি ফিরে পেল। চতুর্থ দিনের শেষভাগে এসে উভয় দল ক্লান্ত। প্রস্তাব করে সন্ধির। সন্ধির স্থাপিত হলো। থেমে গেল গোত্রে-গোত্রে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ। আরব্য প্রথানুসারে মোহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ—এ চারমাস পবিত্র। এ মাসগুলোতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হারাম। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষ প্রথার বাইরে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করে। তাই এর নাম হয় ‘হারবুল ফুজ্জার’—সীমালঙ্ঘনের যুদ্ধ।
যুদ্ধ থামলো বটে; কিন্তু নবি মুহাম্মদের চিন্তা থামে না। চিন্তার রেখা তার কপালকে কুঞ্চিত করছে। অজানা ভয় কাজ করছে ভেরতে ভেতরে। এ সমাধান যে স্থায়ী না। এদের শিরা-উপশিরায় যুদ্ধ। গোত্রে-গোত্রে দ্বন্দ্ব। প্রত্যেকে নিজেদের সেরা প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত। সুযোগ পেলে ছাড় দেবে না কেউ কাউকে। এ সন্ধি টেকসই মনে হচ্ছে না। আবারও হুটহাট যেকোনো সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এমতাবস্থায় শান্তির ঘুম আর হয় কী করে?
“শান্তি-শরাব নিয়ে এল যেই ভবে,
কী করে ঘুমাবে সে একাকী নীরবে?”
কী করা যায়, কী করা যায়—এই ভেবে কাটে দিন। ভাবতে ভাবতে ভাবনার উদ্রেককারীর পক্ষ থেকে ফায়সালা এল। ‘শান্তি সংঘ’ করা গেলে কেমন হয়? সবাই সংঘবদ্ধভাবে শান্তি-প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। সবাই না-হোক, নির্দিষ্ট একটি দল অন্তত এ-কাজ আনজাম দিবে।
এ ভাবনা ভালো। খুবই চমৎকার! নেমে গেলেন মাঠে। শুরুতেই দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গেল। ‘দাবা’য় মন্ত্রী বদ করতে পারলে বাকি কাজ সহজ। মন্ত্রী তাঁর আপন চাচা যোবায়ের। তাকে দিয়ে শুরু করলেন। বোঝাতে লাগলেন দিনরাত। প্রথমে কান না-দিলেও একটা সময় এসে যুবক মুহাম্মদের প্রস্তাবের গুরুত্ব টের পেলেন। সম্মত হলেন। মন্ত্রী বদ হলো। এবার রাজার পালা। চাচাকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন। গোত্রপতিদের দুয়ারে-দুয়ারে ধর্না দেওয়া শুরু। যে করেই হোক। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা লাগবেই। আজ এ দ্বারে তো, কাল ও-দ্বারে। গোত্রপতিতে থামা নয়; যুবকদের টার্গেট করে করে বোঝাতে লাগলেন। দিন যত যায় সমর্থকের পাল্লা ভারি হয়। তবু সবাইকে বাগে আনতে লেগে গেল কয়েক বছর। সময় সে যতই যাক; বাগে আনতে পারাটাই স্বার্থকতা। নয়’শ বছর দীন প্রচার করে নুহ আলাইহিস-সালাম পেয়েছিলেন মাত্র আশিজন। সে হিসেবে কয়েক বছর বেশি সময় না।
আবদুল্লাহ বিন জুদআনের আঙ্গিনায় সবাইকে ডাকা হলো। তিনি পুরো মক্কা-নগরীর খ্যাতিমান দানশীল, দয়ার্দ্র, অতিথিপরায়ণ। একে-একে বনু হাশিম-মুত্তালিব-আসাদ-যুহরা-তামীম-মুররাসহ গোত্র-প্রধানরা উপস্থিত। আলোচনা হলো ঢের লম্বা। সমস্যাগুলো সামনে এনে সমাধানের পথ খোঁজতে লাগলো সবাই। এতদিন নিয়ম ছিল—নিজগোত্রের লোক যত অপরাধই করুক, তার জন্য সাত খুন মাফ। শত-শত বছরের এ প্রথা তারা ভেঙে দিল। সবাই সিদ্ধান্ত নিল—অপরাধী সে যেই হোক; তার ক্ষমা নেই। তাকে শাস্তি পেতেই হবে। যুবকদের নিয়ে গঠন করা হলো শক্তিশালী এক বাহিনী। নাম দিল ‘হিলফুল ফুজুল’। ন্যায়নীতির প্রতিজ্ঞা। শান্তির সংঘ। যুবকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শপথ নিলো—
“*আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করব।
*বহিরাগতদের রক্ষা করব।
*নিঃস্বদের সাহায্য করব।
*দুর্বলদের উপর সবলদের অত্যাচার প্রতিহত করব।”
দিনে-দিনে দৃশ্যপট পাল্টাতে লাগলো। অন্যায়-অবিচার হ্রাস পেতে শুরু করলো। হিলফুল ফুজুলের সদস্যদের ভয়ে দস্যুদের আক্রমণ থেমে গেল। নিরাপদ হলো যাত্রাপথ। বহিরাগতরা বিনা-ঝামেলায় মক্কায় আসা-যাওয়া করতে লাগলো। ব্যবসা-বাণিজ্যে সাধিত হতে থাকে উন্নতি। গোত্রে-গোত্রে দ্বন্দ্বের পরিবর্তে ভ্রাতৃত্ব বাড়তে থাকে। মক্কার বড় বড় মাথাগুলো এতদিন মাথা কাটার ধান্দায় ব্যস্ত ছিল। এখন তারা শান্তি চায়। শান্তি প্রতিষ্ঠার গান গায়। দিকে দিকে যুবক মুস্তফার জয়গান বেজে উঠলো—
হায়রে যুবক, হায় মুহাম্মদ,
দূর করিলি সকল আপদ।
হিংস্র-দানব মানব-মনে
বিজ বুনিলি সঙ্গোপনে।
সেই বিজেতে ফুটলো যে ফুল
নাম হলো তার হিলফুল ফুজুল।
টগবগে এক যুবক। তার কণ্ঠে বজ্রের ধ্বনি। শুরু করলো কবি-সম্রাট ইমরা-উল-কায়েসের কবিতা। কবিতাটি কবির ঘোড়ার বিরত্বে রচিত—
ঊষাকালে যব পাখিরা সবে আপনালয়ে রয় ঘুমে,
তখনি মম ক্ষিপ্র-শিকারি পশমি-অশ্ব যায় ভূমে।
সম্মুখে যেই, পেছনেও সেই, ডানেবাঁয়ে তার এক গতি
চূড়া থেকে পড়া পাথর কিংবা স্রোতের মতই সেই দ্রুতি।
তাকে টেক্কা দিয়ে আরেকজন শুরু করলো। প্রিয়সীর প্রেমে বিভোর আনতারা ইবনে শাদ্দাতের কবিতা—
এভাবে চলছে একের-পর-এক। হঠাৎ খবর এলো ‘উরওয়া’ নিহত হয়েছে। সে হাওয়াজিন গোত্রের লোক। তাকে মেরেছে কিনানা গোত্রের ‘বাররাদ’। মারার পেছনের কারণটা এমন: মক্কার কিছুটা দূরে অবস্থিত ‘হিরা’ রাজ্য। সেখানকার বাদশা নুমান। ব্যবসার উদ্দেশে সে প্রতিবছর উকাজ মেলায় পণ্য পাঠায়। মুদ্রার বিনিময়ে সে-সব নিরাপদে উকাজে পৌঁছায় অন্য একজন। এবার সে দায়িত্ব নেয় উরওয়া। সমস্যা—এই দায়িত্ব নেয়াতে। মক্কার গোত্রগুলি মনে করে—যে অন্যের জান-মালের দায়িত্ব নেয়, সে সম্মানের। তার গোত্র সবার সেরা। ধনে-মানে কুরাইশ ও কিনানা গোত্রের লোকজন অন্যদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করেছে ইতোমধ্যে। তাই তারা মনে করে বহিরাগতদের নিরাপত্তা দিবে কেবল এই দুই গোত্র। উরওয়ার সাথে তাই বাররাদের তর্কে লাগে। বাররাদ বললো, কিনানা গোত্র এখনও বর্তমান। পুচকে হাওয়াজিন গোত্রের লোক এ দুঃসাহস পায় কী করে? উরওয়া বললো, পুরো পৃথিবী তার বিরুদ্ধে গেলেও এ দায়িত্ব নিতে সে প্রস্তুত। শুরু হলো তর্কযুদ্ধ। তর্কে একে-অপরকে ইচ্ছেমতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। একপর্যায়ে বাররাদ সুযোগ বুঝে উরওয়ার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়।
কিনানা গোত্র রক্তপাত ঘটিয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, তাদের উপর আক্রমণ আসবে। মিত্র-গোত্রকে সাহায্য করতে কুরাইশরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো। তারা যতই অপরাধ করুক; বন্ধু বলে কথা। কারণ, আরবদের নীতি হচ্ছে—
“গুণবান যদি পরজন, গুণহীন স্বজন,
তথাপি নির্গুণ স্বজন শ্রেয়, পরঃ পরঃ সদা।”
(মেঘনাদবদ—মাইকেল মধুসূদন দত্ত।)
এদিকে হাওয়াজিন গোত্রের সাথে যোগ দিয়েছে তাদের মিত্র সাকিফ গোত্র। একদিকে কুরাইশ আর কিনানা, অপরদিকে হাওয়াজিন আর সাকিফ। মক্কার কাছাকাছি এসে উভয়ে মুখোমুখি। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। বাঘ আর মহিষের লড়াই। কে আর কারে থামায়। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না। এ-দলে দুজন মরে তো ও-দলের চারজন। ও-দলের চারজন মরে তো এ-দলের ছয়জন।
এভাবে চললো দুদিন। ইতোপূর্বে বাসাস যুদ্ধ চলেছিলো চল্লিশ বছর ধরে। না-জানি এটার স্থায়িত্ব কতদিন বা কত বছর! তৃতীয় দিন যুবক মুহাম্মদ পা টিপেটিপে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত। বয়স এখন বিশের কাছাকাছি। সামান্য একটা ঘটনা। অথচ তা থেকে কী ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সূচনা। দেখে বেশ ক্ষিপ্ত। তবু কাউকে কিছু বলার সুযোগ নেই আপাতত। পুরো গোত্র যুদ্ধ-নেশায় উন্মাদ। চাচারা তাঁকে তাগাড়া দিচ্ছে তীর-বর্শাগুলো সংগ্রহ করতে। পা টিপেটিপে হাঁটছেন, ভাবছেন আর লক্ষ্যচ্যুত হওয়া তীরগুলো সংগ্রহ করছেন। এভাবে শেষ হলো তৃতীয় দিন, যুদ্ধ গড়ালো চতুর্থ দিনে। যুবক মুহাম্মদের পায়ের গুণে নাখলার মাঠ শান্তি ফিরে পেল। চতুর্থ দিনের শেষভাগে এসে উভয় দল ক্লান্ত। প্রস্তাব করে সন্ধির। সন্ধির স্থাপিত হলো। থেমে গেল গোত্রে-গোত্রে রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ। আরব্য প্রথানুসারে মোহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ—এ চারমাস পবিত্র। এ মাসগুলোতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হারাম। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষ প্রথার বাইরে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করে। তাই এর নাম হয় ‘হারবুল ফুজ্জার’—সীমালঙ্ঘনের যুদ্ধ।
যুদ্ধ থামলো বটে; কিন্তু নবি মুহাম্মদের চিন্তা থামে না। চিন্তার রেখা তার কপালকে কুঞ্চিত করছে। অজানা ভয় কাজ করছে ভেরতে ভেতরে। এ সমাধান যে স্থায়ী না। এদের শিরা-উপশিরায় যুদ্ধ। গোত্রে-গোত্রে দ্বন্দ্ব। প্রত্যেকে নিজেদের সেরা প্রমাণে ব্যতিব্যস্ত। সুযোগ পেলে ছাড় দেবে না কেউ কাউকে। এ সন্ধি টেকসই মনে হচ্ছে না। আবারও হুটহাট যেকোনো সময় যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। এমতাবস্থায় শান্তির ঘুম আর হয় কী করে?
“শান্তি-শরাব নিয়ে এল যেই ভবে,
কী করে ঘুমাবে সে একাকী নীরবে?”
কী করা যায়, কী করা যায়—এই ভেবে কাটে দিন। ভাবতে ভাবতে ভাবনার উদ্রেককারীর পক্ষ থেকে ফায়সালা এল। ‘শান্তি সংঘ’ করা গেলে কেমন হয়? সবাই সংঘবদ্ধভাবে শান্তি-প্রতিষ্ঠায় কাজ করবে। সবাই না-হোক, নির্দিষ্ট একটি দল অন্তত এ-কাজ আনজাম দিবে।
এ ভাবনা ভালো। খুবই চমৎকার! নেমে গেলেন মাঠে। শুরুতেই দারুণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া গেল। ‘দাবা’য় মন্ত্রী বদ করতে পারলে বাকি কাজ সহজ। মন্ত্রী তাঁর আপন চাচা যোবায়ের। তাকে দিয়ে শুরু করলেন। বোঝাতে লাগলেন দিনরাত। প্রথমে কান না-দিলেও একটা সময় এসে যুবক মুহাম্মদের প্রস্তাবের গুরুত্ব টের পেলেন। সম্মত হলেন। মন্ত্রী বদ হলো। এবার রাজার পালা। চাচাকে নিয়ে কাজ শুরু করলেন। গোত্রপতিদের দুয়ারে-দুয়ারে ধর্না দেওয়া শুরু। যে করেই হোক। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা লাগবেই। আজ এ দ্বারে তো, কাল ও-দ্বারে। গোত্রপতিতে থামা নয়; যুবকদের টার্গেট করে করে বোঝাতে লাগলেন। দিন যত যায় সমর্থকের পাল্লা ভারি হয়। তবু সবাইকে বাগে আনতে লেগে গেল কয়েক বছর। সময় সে যতই যাক; বাগে আনতে পারাটাই স্বার্থকতা। নয়’শ বছর দীন প্রচার করে নুহ আলাইহিস-সালাম পেয়েছিলেন মাত্র আশিজন। সে হিসেবে কয়েক বছর বেশি সময় না।
আবদুল্লাহ বিন জুদআনের আঙ্গিনায় সবাইকে ডাকা হলো। তিনি পুরো মক্কা-নগরীর খ্যাতিমান দানশীল, দয়ার্দ্র, অতিথিপরায়ণ। একে-একে বনু হাশিম-মুত্তালিব-আসাদ-যুহরা-তামীম-মুররাসহ গোত্র-প্রধানরা উপস্থিত। আলোচনা হলো ঢের লম্বা। সমস্যাগুলো সামনে এনে সমাধানের পথ খোঁজতে লাগলো সবাই। এতদিন নিয়ম ছিল—নিজগোত্রের লোক যত অপরাধই করুক, তার জন্য সাত খুন মাফ। শত-শত বছরের এ প্রথা তারা ভেঙে দিল। সবাই সিদ্ধান্ত নিল—অপরাধী সে যেই হোক; তার ক্ষমা নেই। তাকে শাস্তি পেতেই হবে। যুবকদের নিয়ে গঠন করা হলো শক্তিশালী এক বাহিনী। নাম দিল ‘হিলফুল ফুজুল’। ন্যায়নীতির প্রতিজ্ঞা। শান্তির সংঘ। যুবকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শপথ নিলো—
“*আমরা দেশ থেকে অশান্তি দূর করব।
*বহিরাগতদের রক্ষা করব।
*নিঃস্বদের সাহায্য করব।
*দুর্বলদের উপর সবলদের অত্যাচার প্রতিহত করব।”
দিনে-দিনে দৃশ্যপট পাল্টাতে লাগলো। অন্যায়-অবিচার হ্রাস পেতে শুরু করলো। হিলফুল ফুজুলের সদস্যদের ভয়ে দস্যুদের আক্রমণ থেমে গেল। নিরাপদ হলো যাত্রাপথ। বহিরাগতরা বিনা-ঝামেলায় মক্কায় আসা-যাওয়া করতে লাগলো। ব্যবসা-বাণিজ্যে সাধিত হতে থাকে উন্নতি। গোত্রে-গোত্রে দ্বন্দ্বের পরিবর্তে ভ্রাতৃত্ব বাড়তে থাকে। মক্কার বড় বড় মাথাগুলো এতদিন মাথা কাটার ধান্দায় ব্যস্ত ছিল। এখন তারা শান্তি চায়। শান্তি প্রতিষ্ঠার গান গায়। দিকে দিকে যুবক মুস্তফার জয়গান বেজে উঠলো—
হায়রে যুবক, হায় মুহাম্মদ,
দূর করিলি সকল আপদ।
হিংস্র-দানব মানব-মনে
বিজ বুনিলি সঙ্গোপনে।
সেই বিজেতে ফুটলো যে ফুল
নাম হলো তার হিলফুল ফুজুল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন