সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কৃপাসিন্ধু-৫

কৃপাসিন্ধু-৫

হিলফুল ফুজুল এগিয়ে চলছে। দলের সদস্যরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের সমস্যাদি সমাধানের পাশাপাশি বনদস্যু দমন চলছে সমানতালে। যুবক মুহাম্মদের বিচিত্রতা বাড়তে থাকে দিনদিন। একজায়গায় খোঁজে পাওয়া যায় না বেশিক্ষণ। লোকালয়ে মন বসে না। এই বসে আছে, গল্প করছে, পরমুহূর্তেই অদৃশ্য। ছোটে চলে বিজনভূমে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে, নীরবে ধ্যানমগ্ন হয়, বিচরণ করে ভাবের রাজ্যে। প্রকৃতির অলিগলিতে ঘোরাঘুরি। চাঁদ-তারাদের সাথে আলাপ জমায়। গাছগাছড়ার সাথে সখ্যতা বাড়ে। বন্ধুত্ব জমে বনের পশুপাখির সাথে। গল্প জমে অজানা-অচেনা উদ্ভিদের সাথে। একান্ত সঙ্গী পাহাড়-পর্বত। গুহা তার কেন্দ্রবিন্দু।

বাবা-মা নেই। নেই দাদা-দাদিও। আপন বলতে চাচা আবু তালিব। তার সাথে বানিজ্যে যায় মাঝে-মাঝে। এ-ছাড়া প্রায় একাকীই কাটে। মাঝে-মাঝে লোকালয়ে যায়। মিশে লোকেদের সাথে। কিন্তু ধারণ করে না কাউকে। ছড়িয়ে আসে নিজ আদর্শ—শান্তির বাণী, সম্প্রীতির মন্ত্র। হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাঁর দিকে দৃষ্টি ঘুরে কর্তাদের। অন্যায়ের ভীতে লাত্থি মেরে ন্যায় মশাল গেঁড়ে দিয়েছেন ইতোমধ্যে। সময়ে অসময়ে কাজে-বেকাজে পরামর্শ চায় অনেকে। মিছেদের রাজ্যে তাঁর সত্যবাদিতায় মুগ্ধ সবাই। অবিশ্বাসের দোলাচালে ভাসতে থাকা আরবদের বিশ্বাসের ক্ষেন্দ্রবিন্দু হতে থাকে দিনদিন। যুদ্ধ-উন্মাদ মনে রোপন করে দিয়েছেন শান্তির চারাগাছ। দিকে দিকে খ্যাতির জোয়ার বইতে থাকে দ্রুত। আকণ্ঠ সত্যে পরিপূর্ণ, আপাদমস্তক বিশ্বস্ত বলে লোকজন তাঁকে সম্বোধন করা শুরু করলো ‘আল-আমিন’ বলে। তাঁর চরিত্রের উৎকর্ষতা নানামুখী। আল-আমিন শব্দের অর্থও ব্যাপক। শান্তির বার্তাবাহক, বিশ্বাসের মূর্তপ্রতিক ইত্যাদি। সময়ের পরিক্রমায় মুহাম্মদ নামকেই ভুলতে বসেছে লোকজন। দেখা হলেই আল-আমিন! কথা উঠলেই আল-আমিন! বাচ্চারা দূর থেকে ডাকে—আল-আমিন, আল-আমিন! দিন যত যায় খ্যাতি তাঁর পায়ের দাসে পরিণত হতে থাকে।

মক্কার ঘরেঘরে এখন তাঁর নামডাক। নারী-পুরুষ একনামে চেনে। নামটা আল-আমিন—পরম বিশ্বস্ত। সে নাম পৌঁছে যায় খাদিজার কানেও। খাদিজা(বংশ পরিচয়) তিনিও অন্য নামে প্রসিদ্ধ ইতোমধ্যে। সে নাম ‘তাহিরা’। তাহিরা মানে পবিত্র। নিষ্কলুষ। যে-রাজ্যে নারীরা ভোগবিলাসের বস্তু, আমোদপ্রমোদের একক উপাদান, সে-রাজ্যে খাদিজা সদর্পে আপন চরিত্রে মহীয়সী হিসেবে উদ্ভাসিত। দু-দুটো স্বামীর ইন্তেকালেও তাঁর প্রভাব কমেনি এতটুকুও। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স; তবু তার ছাপ নেই চেহারায়। দেখতে পঁচিশ বছরের যুবতির মতোই লাগে। শরীরও ভাঙেনি একটুকুও। কোনো ঐশ্বরিক শক্তি যেন তাঁর বয়স বাড়তে দিচ্ছে না। চরিত্রে কালিমা লেপনের কোনো সুযোগই রাখেননি। চরিত্র যেমন সুদৃঢ়, সম্পদও তাঁর পাহাড়তুল্য। অঢেল সম্পদের মালিক। আরবের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন ইতোমধ্যে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য লোক রেখেছেন অনেক। দূর সিরিয়ায় পণ্য পাঠায় লোকেদের মাধ্যমে।

দেখতে দেখতে আবারও সময় এসেছে। সিরিয়ায় পণ্য পাঠাবে। পণ্যগুলো একত্রিত করা হলো। পরিমাণ হয় বিশাল। পুরো কুরাইশদের সব একত্রিত করেও সেগুলির সমান হয় না। বিশ্বস্ত কাউকে দরকার। যে আমানতের খেয়ানত করবে না। ভেবেচিন্তে আল-আমিনের উপরেই ভরসা রাখে। তাঁকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। চাচা আবু তালিবের পরামর্শে তিনি সম্মত হলেন। সহায়তার জন্য খাদিজার গোলাম মায়সারাকে দিলেন সাথে। যাত্রা শুরু হলো।

নিয়মিত যাত্রা-বিরতি করে করে চললো কয়েকদিন। পথে মায়সারা আজব আজব কাণ্ড দেখে। পথের গাছপালা তাঁর দিকে ঝুকে পড়ে। অদৃশ্য থেকে কেউ যেন তাঁকে সালাম দেয়। যেতে যেতে বুসরায় পৌঁছল কাফেলা। বুসরাকে মনে আছে তো? ঐ যে, পাদ্রী বাহিরার গির্জা, সেখানে খাওয়া-দাওয়া, আলামত দেখে ভবিষ্যতবাণী... ঠিক ধরেছেন। সেই বুসরা। এবার যাত্রা থামলো অন্য গির্জার পাশে। বিশ্রামের জন্য এবারও বসলেন গাছের ছায়ায়। দূর থেকে পাদ্রি তা অবলোকন করছে। না, বাহিরা নয়, এই পাদ্রির নাম নাসতুরা। তার সাথে মায়সারার আলাপ জমে ওঠেছে। মায়সারাকে পাদ্রির জিজ্ঞাসা—গাছের ছায়ায় বসা ওই ব্যক্তি কে?
মায়সারা জবাব দিলো—মক্কার অধিবাসী। কুরাইশ বংশের লোক। আবার জিজ্ঞাসা—তাঁর চোখ হালকা লালচে কি-না? মায়সারা হাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো—চোখগুলো সবসময় ঐরকমই থাকে। পাদ্রি বললেন, “ঈসা আ. ব্যতীত অন্য কোনো নবি ঐ গাছের নিচে বসেনি কখনও। ঐ যুবক এ উম্মতের শেষনবি।” আল-আমিন যথারীতি সিরিয়ায় গিয়ে বাণিজ্যে অংশে নিলেন। ব্যবসায়ীরা তাঁর ব্যবহারে মুগ্ধ। বিক্রি করে লাভ হলো ব্যাপক। যা কেনা প্রয়োজন তাও কিনলেন। ফেরার পালা। মক্কার বহুদূর। আল-আমিন আর মায়সারা বেশ খুশিমনেই ফিরছে...

রীতিমতো দুপুরের খাওয়া সেরে জানালার ধারে গিয়ে বসলেন খাদিজা। দূর নীলিমায় চোখ আঁটকে আছে তাঁর। বিগত দিনের স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জীবন থেকে চলে গেছে ঊনচল্লিশটি বছর। অথচ জীবনের পরম মুহূর্ত বুঝি এখনও অধরাই রয়ে গেল। দুই-দুজনের সাথে ঘর বেঁধেও কপালভাগ্যে টিকেনি বেশিদিন। উদাস মন। দৃষ্টি আকাশ থেকে ধীরে ধীরে পথে নেমে আসে। একদৃষ্টে অপলক চেয়ে আছে। দেখতে দেখতে নজর পড়ে এক কাফেলার ওপর। কাফেলার মাঝে স্বোজ্জ্বল এক যুবক। খাঁ খাঁ রোদ। কিন্তু যুবক বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। তাঁর গায়ে রোদ নেই; আছে ছায়া। কোথা থেকে? কৌতুহল নিয়ে উপরে তাকায়! একি! আজব কাণ্ড! একখণ্ড মেঘ তাঁর সাথে সাথে ভাসছে! মনে হচ্ছে দুজন লোক তা টেনে টেনে আনছে। যুবক থামলে সেটা থামে; হাঁটলে সেটাও হাঁটে।।

দেখতে দেখতে যুবকের মুখ পরিষ্কার হতে থাকে। খাদিজার অনুসন্ধিৎসু চোখ তাঁর চেহারা থেকে সরে না।
“চাতক প্রায় অহর্নিশি,
চেয়ে আছে কালো শশী।”—লালন সাঁই
লালন চোখকে কালো চাঁদ বলেছে। একদৃষ্টে সেই কালো চাঁদ যুবকের চেহারার দিকে তাকিয়ে। আরে, এ তো আল-আমিন! খাদিজার মন আনন্দে নেচে ওঠে। বাণিজ্যের লাভ-লোকসানের খবর এখনও তার কানে পৌঁছেনি; তবুও তাঁর আনন্দ ধরে না। খাদিজা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে—এ আনন্দ কীসের? অদ্ভুত এ প্রশ্ন! খাদিজা নিজেও জানে না তার উত্তর! দেখতে দেখতে বাড়ির আঙ্গিনায় উপস্থিত আল-আমিন ও মায়সারা। খাদিজার উষ্ণ-অভ্যর্থনায় সিক্ত হলেন দুজন। হিসাব কষে দেখা গেল ব্যবসায় লাভ হয়েছে প্রচুর। সেটা অন্যান্য বারের তুলনায় দ্বিগুণ। আল-আমিনের বিশ্বস্ততা আর সত্যবাদিতায় খাদিজা চরম পুলকিত। তাই তাঁকে পুরস্কৃত করলেন দ্বিগুণ হিসাব করে। পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে বিদায় হলেন। কিন্তু খাদিজার কৌতুহল বিদায় হয় না...

অবসরে মায়সারাকে আপন কক্ষে ডাকে। তার কাছে সফরের আদ্যোপান্ত জানতে চায়। মায়সারাও বলে এক-এক করে। যাওয়ার পথে অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা, অদৃশ্য থেকে সালাম আদান-প্রদান, নাসতুরার ভবিষ্যতবাণী, ব্যবসায়ীদের সাথে আচরণ সব। খাদিজার কৌতুহল বেড়ে যায় বহুগুণ। তাঁর মনে দীপ্তি ছড়াতে শুরু করে। অস্থিরতা কাজ করতে থাকে। হার্টবিট বেড়ে দম বন্ধ হয় হয় অবস্থা। ঘরে আর মন টেকে না। দৌড়ে যায় ওয়ারাকার কাছে। ওরারাকা তাঁর চাচাতো ভাই। তার নাম ইতোমধ্যে আমরা একবার জেনে এসেছি। শিশুনবির হারিয়ে যাওয়ার পর যিনি খোঁজে পেয়ে দাদা আবদুল মুত্তালিবের হাতে সোপর্দ করেছিলেন। হ্যাঁ, ইনিই সে ওয়ারাকা। ভারি পণ্ডিত লোক। তাওরাত ও ইঞ্জিল কিতাবের জ্ঞানে সমৃদ্ধ।  জ্ঞানে-গুণে তাঁর খ্যাতি আরবময়। খাদিজা তাকে ঘটনার আদ্যোপান্ত খোলে বললেন। ওয়ারাকা কিছুক্ষণ একমনে ভাবলেন। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে জানালেন, “এসব ঘটনা সত্যি হলে তিনিই এ উম্মতের নবি। হিসাব মতে সম্প্রতি শেষনবি আসার কথা। আমরা তাঁর প্রতিক্ষায় আছি।”

খাদিজা এবার নিশ্চিত হয়। পণ করে আল-আমিনকে তাঁর পেতেই হবে। এ জনমের সব শূন্যতা সেঁ-ই পূরণ করতে পারে। তিনিই সেঁ যুবক, যাঁর অপেক্ষায় বহু সম্ভ্রান্ত লোকের প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিয়েছে ইতোমধ্যে। অতএব সময় এসেছে। আমাবস্যাময় জীবনে প্রতীক্ষিত চাঁদের উদয় হয়েছে। আর দেরি করা সমীচীন হবে না। পত্র লিখলেন আল-আমিন বরাবর: “হে চাচাতো ভাই, আপনার গোত্র এ আরবে শ্রেষ্ঠ। সেই শ্রেষ্ঠগোত্রে আপনার শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজন বিদিত। সে শ্রেষ্ঠত্ব যেমন বিশ্বস্ততায়, তেমনি সত্যবাদিতায়। চারিত্রিক মাধুর্যতায় আপনি যেন কাঁটাহীন গোলাপ। আত্মীয়তার বন্ধনে আপনার চেয়ে উত্তম আর কে হতে পারে! আমি মুগ্ধ, আমি বিভোর, আমি অভিভূত! তাই, আমার সকল গৌরব আপনার কদমে সমর্পণ করতে চাই৷ সহধর্মিণীরূপে এ বান্দিনীকে যদি গ্রহণ করেন; তবে বাকি জীবন দাসী হয়ে আপনার সেবায় কাটাতে চাই।”

প্রস্তাব পেয়ে আল-আমিন চিন্তায় পড়ে। জবাব দিতে লজ্জাবোধ হয়। অভিভাবক বলতে চাচা আবু তালেব একজন আছেন৷ তার কাছে যায়। তাকে জানায়। প্রস্তাব শোনে আবু তালেব খুশি হয়। তিনি ভেবে দেখেন—পিতা-মাতাহীন আল-আমিনের জন্য পিতা-মাতাহীন খাদিজাই পারফেক্ট। খাদিজার আছে অঢেল সম্পদ, আল-আমিনের আছে বিশ্বস্ত হাত-নিষ্কলুষ আত্মা! এ দুটো একত্র হলে কুরাইশদের সমৃদ্ধি আরও বাড়বে। তাই ভেবেচিন্তে সে খাদিজার পস্তাবে আল-আমিনের সম্মতির কথা জানায়। খাদিজা আনন্দে মরে মরে অবস্থা। তাঁর গৌরব আর ঐশ্বর্যের পূর্ণতা পেতে চলেছে। শাসকহীন রাজ্যে রাজার আগমন হচ্ছে। মুকুটহীন রাণীর মাথায় মুকুট বসতে যাচ্ছে। বাড়ির দেয়ালগুলি আপনাআপনি সেজে ওঠছে। রঙ চকচকে ঝকঝকা হচ্ছে তার সর্বাঙ্গ। সেথায় ফুরফুরে ভাব। মেজাজে সুরসুরে সুর। মনে উরু উরু গান। চেহারায় হলদে ভাব, চাঁদের দ্যুতি। মুখে লাজ-লাজ ঢং। আঙিনায় প্রজাপতির নাচ৷ রাতে জোনাকির হাট। বৃক্ষলতার আকাশ ছোঁয়ার তাড়া।

খাদিজার বাড়িতে বরপক্ষ আর কনেপক্ষ সমবেত। বর-কনে আপন আপন সাজে সজ্জিত। দুজন পাশাপাশি বসে। আল-আমিনের দ্যুতি এমনিতেই ছড়ায় সবসময়। গোলাপ থেকে সুগন্ধ বেরোবেই। চাঁদ থেকে জ্যোছনা ছড়াবেই—এটি সভাবধর্ম। কিন্তু গোলাপ যদি কোনো অপ্সরার হাতে থাকে? অপ্সরা নয়; খাদিজা আজ জান্নাতি হুর। তাঁর পাশে যুবক আল-আমিন! এমন দৃশ্য কবির কল্পনায় কেমন ধরে?
“হায় কে দেখেছে কবে, দুইচাঁদ এক নভে
সেহেলি সখিরা সবে মূক বাণী-হারা
কাহারে ছাড়িয়া কারে দেখিবে বুঝিতে নারে
স্তব্ধ অচপল-গতি তাই আঁখিহারা।”
—নজরুল
বাতাসের ছোঁয়ার ব্যস্ত রোদের ক্লান্তি মুছে যাচ্ছে। সূর্যরশ্মিতে মিষ্টত্ব এসে গেছে। তার তেজ উবে গেছে। তার প্রতাপে গা জ্বলে না; মোহনীয় শিহরণ জাগে। জোড়া তারার ঝলকে তারার দেশে দ্যুতির হিমপ্রবাহ ছড়িয়ে পড়েছে। আরশ-কুরসি-লৌহ-কলমেও এক ঝটকায় তা পৌঁছে গেছে। জান্নাতের সুবাসিত ফুলের গায়ে সেই দ্যুতি লেগে তার ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যায়। জান্নাত রূপ নিলো নতুন এক জান্নাতে। বিয়ের আয়োজক স্রষ্টা। সৃষ্টিকুলের অনু-পরমাণু সবে আজ মেহমান। এ আনন্দে সবাই শরিক।

আবু তালিব খুতবা শুরু করলেন। “আলহামদুলিল্লাহ! যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর। তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন হজরত ইবরাহীমের বংশে। ইসমাইলের প্রস্ফুটিত বাগানে।মায়াদের মূল হতে। এবং সর্বশেষ মুদাবের পরম্পরায়। পবিত্র কাবাঘরের খাদেম করে সেটির মর্যাদা রক্ষার কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। তাতে তাওয়াফ করার তৌফিক দিয়েছেন। সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিরাপদ স্থানরূপে। আর আমাদের বানিয়েছেন সর্বসাধারণের বিচারক। সমবেত লোকজন! আমার ভাতিজা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ সম্পর্কে আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন। জ্ঞানে-গুণে, মর্যাদা-মহত্বে তাঁর সমান কেউ নেই। হতে পারে তাঁর ধনসম্পদ কম; কিন্তু পার্থিব এ ধনসম্পদ খুবই অস্থায়ী। আশা করছি তাঁর এ অবস্থা দ্রুতই কেটে যাবে। অতঃপর, বিশটি উট মোহরানা দেয়ার শর্তে তাঁর সঙ্গে খুওয়ালিদ-কন্যা খাদিজার পরিণয়ের প্রস্তাব করছি।”

খাদিজার পক্ষে ওয়ারাকা বলতে শুরু করলো। “প্রশংসাসমূহ আল্লাহর জন্যই, যিনি আমাদেরও একইরকম মর্যাদা উন্নিত করেছেন। হে আবু তালেব, আপনার বক্তব্যে আমি একমত। আপনাদের বংশমর্যাদা ও আভিজাত্য পুরো আরবে স্বীকৃত। তা অস্বীকারের উপায় নেই। আমরা আন্তরিকতার সাথে আপনাদের সাথে আত্মীয়তায় আগ্রহী। উপস্থিত সবে সাক্ষী। আমি খাদিজাকে উল্লেখিত মোহরানার শর্তে মুহাম্মদের সাথে বিয়ে দিলাম।” খাদিজার চাচা আমর ইবনে আসাদও ওয়ারাকার সুরে সুর মিলালেন। আল-আমিন কবুল বলে খাদিজাকে গ্রহণ করলেন। কবুল বলে খাদিজাও আল-আমিনের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করলেন। চারিদিকে দুন্দুভি বেজে ওঠলো। আকাশে ফেরেশতারা গান ধরেছে। হুরপরীরা নৃত্য করে করে ওড়ছে। পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত আনন্দের বান ছুটেছে। আকাশের সব তারা ঝিকমিকিয়ে জ্বলছে। প্রকৃতির কোলে নেমে এসেছে খুশির জোয়ার। সে খুশির ধরাবাঁধা নেই। যে যার মতো আনন্দে মত্ত। নৃত্যে মশগুল। কারটা আর কে দেখে!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...