প্রশংসিত-৬
খাদিজা সাত রাজার ধন পেয়ে বসেছে। সাত না; রাজাদের রাজার ধন। আরে না, স্বয়ং রাজা পেয়ে বসে আছেন। খাদিজা থেকে খাদিজাতুল কুবরা হয়েছেন। তাঁর আর সম্পদ চায় না। চায় শুধু প্রেমাস্পদের ভালোবাসা-সন্তুষ্টি। সব সম্পদ প্রেমাস্পদের পদতলে উজাড় করে দিলেন। নব-দোলহা রাতারাতি সম্পদশালী। কিন্তু এ সম্পদ তিনি কী করবেন? তিনি তো বিলাতে এসেছেন, ভোগ করতে নয়। কার মেয়ের বিয়ে আঁটকে গেছে, কোন গরীব না-খেতে পেয়ে মরছে, কোন বিধবা সম্বলহীনা, কার মাল দস্যুরা লুটে নিয়েছে—খোঁজে খোঁজে দান করা শুরু। পৃথিবীময় প্রসারিত এ হাত—দানে থামে না। ফকির হওয়ার ভয় করে না। কমে যাওয়ার চিন্তায় মজে না। পরম দাতা যাঁর সাথে, কমার ভয় কি তাঁর সাজে?
সাজে না। সাজা থেকে সাজগোজ। ওসবের বালাই ছাট। দরকার পড়ে না। সুন্দরম পরমং। প্রকৃতি তারে নানাভাবে সাজিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। তার কাছে প্রকৃতি সাজে। অভাবনীয় মিশেল। পূর্ণ যুবক। টগবগে চেহারা৷ মাথায় বাবরি চুল। দেখতে মাঝারি গড়ন। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে দূর থেকেও দেখা যায়। পুরো কোরাইশ গোত্রের মধ্যমণি এখন। আল-আমিন নামের প্রচার আরো প্রসারিত হয়েছে। ঘোড়ায় চড়লে তাঁকে আর থামায় কে? হ্যা, ঘোড়ায় এখন চড়া হয় নিয়মিত। সিরিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল খাদিজার। সে-সবের দেখাশোনা এখন নিজেকেই করতে হয়। গোত্রের দশজনের একজনও বটে। মধ্যমণি বলেছিলাম। তাঁকে ছাড়া আসর জমেই না।
কিন্তু আসরে তাঁর মন মজে না অত। সবাইকে মজিয়ে নিজে কেটে পড়ে। নিরালা ভালো লাগে৷ কিছু সময় একাকী অনন্ত সত্তার সন্ধানে না-কাটালেই নয়। তাই সুযোগ পেলেই ছোটে চলেন বিজনভূমে। লোকালয়ের অন্তরালে। পরম আরাধ্যকে খোঁজে বেড়ান বন থেকে বনান্তরে।
দেখতে দেখতে খাদিজার কোলও পূর্ণ হয়। বিয়ের দুবছর পর জন্ম হয় নবিজাদা কাশেমের। দুবছর পর মারাও গেলেন। পরের বছর আবার আলোর দেখা। বিবি জয়নবের জন্ম। জন্ম হয় কাশেম, তৈয়ব, তাহেরেরও। কিন্তু বিধির বিধান। শেষনবির পুত্র রবে না। সবাই মারা যায় অল্পবয়সে। তাঁর কাঁধে পুরো দুনিয়ার সন্তানদের ভার। চারপু্ত্রের বাড়তি ভার চাপিয়ে দেবেন কেন? এই কি হেকমত? এই কি রহস্য? জানা নেই। রহস্য রহস্যই থাক। পুত্রহারা খাদিজার কোল পুত্রশোকে বিভোর হতে দেননি। একে-একে দুনিয়া আলোকিত করেছেন, রুকাইয়া, কুলসুমা ও জান্নাত-নেত্রী ফাতেমারা। তাদের কথা না-হয় থাক আপাতত। কোরাইশরা কাবায় কী করছে দেখে আসি।
কাবা শরিফের কিনারায় কোরাইশ নেতারা৷ পরামর্শ সভা বসেছে। কাবার দেয়ালে চিড় ধরেছে। দুদিন আগে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়েছিল এক মহিলা। সেখান থেকে গিলাফে আগুন লেগে যায়। গিলাফ পুড়ে গেছে। সাথে দুর্বল হয়েছে দেয়ালও। পাশের পাহাড় থেকে বর্ষার পানি এসে ডুবিয়ে যায় মাঝে মাঝে। সংস্কারের সময় এসে গেছে। সংস্কার করা যায় কিনা? করলে কীভাবে করবে—এই নিয়ে পরামর্শ।
একজন বললো, পুরোনো দেয়াল ভেঙে নতুন করে বাঁধতে হবে। অপরজন আপত্তি জানালো। বললো, খোদার ঘরে হাত দেয়া ঠিক হবে না। দেখতে পণ্ডিত সাদা দাড়িওয়ালা একজন দাঁড়িয়ে গেল। আগেরজনের আপত্তির জবাবে লম্বা ইতিহাস টানলো। ভায়েরা, দেয়াল ভাঙা নিয়ে এত চিন্তিত হবার কিচ্ছু নেই৷ এর আগেও এটি বহুবার সংস্কার হয়েছে৷ প্রথমবার বানিয়েছিলেন ফেরেশতারা। তাঁরা এটিতে তাওয়াফ করত। তখন মানুষ ছিল না। ছিল জিন জাতি। এরপর এটিকে সংস্কার করেছেন পৃথিবীর প্রথম মানব, আমাদের আদি-পিতা আদম আলাইহিস সালাম। তারপর করলেন তাঁর পুত্র শীস আ.। নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনের সময় সেটি ধ্বসে যায়৷ ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সময়ে এসে পুননির্মাণ হয়। ঐ যে পাশের সিনাই, যাইতা, লুবানন, জুদি, হিরাপর্বত দেখছেন, সেগুলো থেকে ফেরেশতারা পাথর এনে দিতেন৷ পুত্র ইসমাইল উপরে তুলে দিতেন। নবি ইবরাহিম গাঁথুনি দিতেন৷ মকামে ইবরাহিমটা তখন লিফটের মতো প্রয়োজনানুসারে উপর আর নিচে উঠা-নামা করত। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সেই ভিত এখনো টিকে আছে। তবে এটিতেও আমলেকা সম্প্রদায়, জোহরোম গোত্র ও কুসাই বিন কিলাব সংস্কার সাধন করেছেন। সুতরাং, পুরোনো হয়ে যাওয়া দুর্বল দেয়াল ভেঙে নতুন দেয়াল তৈরিতে বাধা নেই।
কোরাইশরা এই জ্ঞানী লোকটির কথায় ঐক্যমত্য হলো। কিন্তু কাবার দেয়াল ভাঙতে সাহস হচ্ছিল না কারো। ওয়ালিদ বিন মুগিরা এগিয়ে আসলো। উপর দিকে তাকিয়ে বললো, “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না। কেননা, আমাদের উদ্দেশ্য ভালো।” অতঃপর, সে পাথর সরাতে লাগলো। বাকিরা তখনও দর্শক। একজনের সতর্কতামূলক মতামত: চল, আমরা আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি। যদি দেখি, মুগিরার কিছু হয়নি; তবে আমরাও কাজ শুরু করবো।
পরদিন সবাই এসে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে। মুগিরার হাত-পা চারটা একই সাথে কাজ করছে! তার কিছুই হয়নি। কোরাইশরা আশ্বস্ত হয়। না, এ কাজে আল্লাহ রাজি আছেন। এবার সবাই হাত লাগায়। পাথর সরাতে থাকে। দেয়াল ভাঙতে থাকে। ভাঙতে ভাঙতে এক জায়গায় এসে থমকে যায় সবাই। কোদালের কোপ দিতেই পুরো মক্কানগরী কেঁপে ওঠে। পুরো পৃথিবী কেঁপেছিল কি-না কে জানে! সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ ভয়ে শুয়ে পড়ে। সাদা দাড়িওয়ালা আবার এগিয়ে এলো। চারিদিকটা ভালো করে পরখ করে। না, তোমরা আর গভীরে যেয়ো না। এটাই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গড়া মূলভিত্তি। এটার উপরেই আমাদের কাজ করতে হবে। লোকেরা বুঝতে পারে, ভাঙার কাজ শেষ, এবার গড়ার পালা৷ ভাঙলে গড়তে হয়। দুনিয়াটা ভাঙা-গড়ার বালুচর।
গড়ার কাজ শুরু। গোত্রগুলো নিজেদের ভাগ বুঝে নিল। দরজার পাশটা বানু আবদে মানাফ ও যুহরার। হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনির মাঝের স্থান বানু মাখযুম, পিছের অংশ বানু সাহম ও জাহম। হাতিমের অংশ বানু আবদুদ দার ও আদির। রাত-দিন কাজ চলে নাগাতার। সময় ভাগ করে সহযোগী গোত্ররাও কাজ চালিয়ে যায়। হেরা, সাবির, হালহালা থেকে পাথর এনে গাঁথুনি চলে। গড়নে আসে সামান্য ভিন্নতা। দেখতে দেখতে মূল ভিত্তি থেকে উপরে উঠলো আঠারো হাত। আগে ছিল নয় হাত। উচ্চতা আগের দ্বিগুণ। এবার থামা যাক।
দরজা লাগাতে হবে। সুখবর আসে লোহিত সাগর থেকে। মক্কা থেকে তার দূরত্ব ১২০ কি.মি.। সেখানে রোম থেকে আসা একটি জাহাজ ভেঙে খানখান হয়েছে। সেটির কাঠ-লোহা বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। কোরাইশ নেতারা ছোটে যায় দ্রুত। জাহাজের বিরাট কাঠখণ্ড কিনে দরজার জন্য। সাথে সেখানকার মিস্ত্রিকেও নিয়ে আসে। এক কাঠে পুরো দরজা শেষ। জোড়া-তালি নাই। আগে ছাদ ছিল না। এবার ছাদ হলো। ছয়টি খুঁটিতে সে ছাদ দাঁড়িয়ে।
সব কাজ শেষ। কাবাঘর লাভ করলো নতুনত্ব। ‘হাজরে আসওয়াদ’টা এখনো লাগানো হয়নি। হাজরে আসওয়াদ মানে কালো পাথর। পাথরটি জান্নাতি। নাম ইয়াকুত। ছিল ধবধবে সাদা। পাপীর পাপ পরিশোধন করতে করতে হয়েছে কালো। নাম হয়ে যায় কালো পাথর। এনেছিলেন ফেরেশতারা। সেই আদম আলাইহিস সালামকে পাঠানোর সময়। নবি ইবরাহিম আলাইহিস সালাম লাগিয়েছিলেন কাবার পূর্বকোণে। সেই মর্যাদাপূর্ণ পাথর কাবায় স্থাপন করা হবে। কিন্তু কে করবে এ কাজ? কাবা নির্মাণের সবচে’ সম্মানিত কাজের সম্পাদক হবে কে?
কোরাইশের গোত্র সব দাঁড়িয়ে
দেয় হাত বাড়িয়ে,
আমিই করব, আমিই করবো—
অন্যদের হারিয়ে।
সবাই সবাইকে হারাতে চায়। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার মোক্ষম সুযোগ। হাতছাড়া করা বোকামি। তুমুল তর্ক শুরু—আমি আর আমার গোত্র সেরা। চললো নাগাতার চারদিন। বন্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করল। পুরোনো নেশা জেগে উঠলো আবার। রক্তে হাত ডুবিয়ে শপথ নেয় একে একে। রণ-হুঙ্কার ঐ শোনা যায়...
পুণ্যে যা শুরু পাপে তার বিনাশ। বৃদ্ধ উমাইয়ার মন মানে না। খেলাতে খেলাতে মাথায় খেল এলো। সবার প্রতি শেষ আহ্বান: ওহে তোমরা থামো। বড় পুণ্য কামিয়েছো সবে। শেষকালে তার জলাঞ্জলি দিচ্ছো কোন কারণে। এ চরম ভুল। এ চরম লঙ্ঘন। শোনো কী বলি—আগামীকাল সবার প্রথম যে কাবার দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেব। সে যা বলে তাতে সম্মত হব। বৃদ্ধ উমাইয়া বুদ্ধিতে সবার শুদ্ধি ফিরল। এ যুক্তিতে হয়ত মুক্তি মিলবে—এ আশায় পরদিন সকালের অপেক্ষা...
হুদহুদ পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে কাবা-বাসীর। একে একে জড়ো হয় কাবার পাশে। হেরেমের দুয়ারে সবার চোখ। কে আসবে? এই রণ-হুঙ্কার কে থামাবে? কী-ই বা দিবে সমাধান? নানান জল্পনা-কল্পনা। দেখতে দেখতে এক যুবকের আগমন। আধাঁরের বিদারণ। আলোর দেখা। ঝলমলে চেহারার যুবককে দেখে সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো—
“হা-জা মুহাম্মদ, হা-জা মুহাম্মদ! আল-আমিন, আল-আমিন! রাদ্বি’না-হু, রাদ্বি’না-হু। হা-জা মুহাম্মদ, হা-জা আল-আমিন!”
“আরে, এই তো মুহাম্মদ এই মুহাম্মদ! পরম বিশ্বস্ত, পরম বিশ্বস্ত! তাঁর সিদ্ধান্তে আমরা রাজি, আমরা রাজি। এ তো মুহাম্মদ, পরম বিশ্বস্ত, পরম বিশ্বস্ত!”
উমাইয়া এগিয়ে আসলো। বাবা, তুমি এসেছো? বেশ ভালো হয়েছে, বেশ ভালো হয়েছে। মনে হয়, আল্লাহই তোমাকে আমাদের জন্য পাঠিয়েছে। হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে বেশ ঝামেলা বেঁধেছে। তুমি একটা সমাধান দাও। সবাই তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।
কিছুক্ষণ সবকিছু স্তব্ধ। পিঁপড়ের হাঁটার শব্দও শোনা যাচ্ছে। আল-আমিন গায়ের চাদরটা মাটিতে রাখলেন। সেটার উপর রাখলেন হাজরে আসওয়াদ। আহ্বান জানালেন— এবার গোত্রপ্রধানরা এগিয়ে আসুন। চাদরের কোণায় ধরে এটিকে তুলুন। গোত্রপ্রধানদের সম্মিলিত শক্তিকে পাথর উপর ওঠলো। এবার এগিয়ে চলুন। যেতে যেতে কাবার পূর্বকোণা। হয়েছে, থামুন। এবার পাথরটিকে তিনি হাতে তুলে নিলেন। লাগিয়ে দিলেন যথাস্থানে! অতঃপর অনুরাগভরে সেটার উপর দীর্ঘ চুম্বন! চারিদিক থেকে করতালির আওয়াজ আসছে—
ওরে সত্যব্রতী আল-আমিন,
করলে এ কী সংজ্ঞাহীন!
এক চাদরে সবারে শামিল
সাম্যবাদের এ কোন বীণ!
খাদিজা সাত রাজার ধন পেয়ে বসেছে। সাত না; রাজাদের রাজার ধন। আরে না, স্বয়ং রাজা পেয়ে বসে আছেন। খাদিজা থেকে খাদিজাতুল কুবরা হয়েছেন। তাঁর আর সম্পদ চায় না। চায় শুধু প্রেমাস্পদের ভালোবাসা-সন্তুষ্টি। সব সম্পদ প্রেমাস্পদের পদতলে উজাড় করে দিলেন। নব-দোলহা রাতারাতি সম্পদশালী। কিন্তু এ সম্পদ তিনি কী করবেন? তিনি তো বিলাতে এসেছেন, ভোগ করতে নয়। কার মেয়ের বিয়ে আঁটকে গেছে, কোন গরীব না-খেতে পেয়ে মরছে, কোন বিধবা সম্বলহীনা, কার মাল দস্যুরা লুটে নিয়েছে—খোঁজে খোঁজে দান করা শুরু। পৃথিবীময় প্রসারিত এ হাত—দানে থামে না। ফকির হওয়ার ভয় করে না। কমে যাওয়ার চিন্তায় মজে না। পরম দাতা যাঁর সাথে, কমার ভয় কি তাঁর সাজে?
সাজে না। সাজা থেকে সাজগোজ। ওসবের বালাই ছাট। দরকার পড়ে না। সুন্দরম পরমং। প্রকৃতি তারে নানাভাবে সাজিয়ে দেয় প্রতিনিয়ত। তার কাছে প্রকৃতি সাজে। অভাবনীয় মিশেল। পূর্ণ যুবক। টগবগে চেহারা৷ মাথায় বাবরি চুল। দেখতে মাঝারি গড়ন। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে দূর থেকেও দেখা যায়। পুরো কোরাইশ গোত্রের মধ্যমণি এখন। আল-আমিন নামের প্রচার আরো প্রসারিত হয়েছে। ঘোড়ায় চড়লে তাঁকে আর থামায় কে? হ্যা, ঘোড়ায় এখন চড়া হয় নিয়মিত। সিরিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল খাদিজার। সে-সবের দেখাশোনা এখন নিজেকেই করতে হয়। গোত্রের দশজনের একজনও বটে। মধ্যমণি বলেছিলাম। তাঁকে ছাড়া আসর জমেই না।
কিন্তু আসরে তাঁর মন মজে না অত। সবাইকে মজিয়ে নিজে কেটে পড়ে। নিরালা ভালো লাগে৷ কিছু সময় একাকী অনন্ত সত্তার সন্ধানে না-কাটালেই নয়। তাই সুযোগ পেলেই ছোটে চলেন বিজনভূমে। লোকালয়ের অন্তরালে। পরম আরাধ্যকে খোঁজে বেড়ান বন থেকে বনান্তরে।
দেখতে দেখতে খাদিজার কোলও পূর্ণ হয়। বিয়ের দুবছর পর জন্ম হয় নবিজাদা কাশেমের। দুবছর পর মারাও গেলেন। পরের বছর আবার আলোর দেখা। বিবি জয়নবের জন্ম। জন্ম হয় কাশেম, তৈয়ব, তাহেরেরও। কিন্তু বিধির বিধান। শেষনবির পুত্র রবে না। সবাই মারা যায় অল্পবয়সে। তাঁর কাঁধে পুরো দুনিয়ার সন্তানদের ভার। চারপু্ত্রের বাড়তি ভার চাপিয়ে দেবেন কেন? এই কি হেকমত? এই কি রহস্য? জানা নেই। রহস্য রহস্যই থাক। পুত্রহারা খাদিজার কোল পুত্রশোকে বিভোর হতে দেননি। একে-একে দুনিয়া আলোকিত করেছেন, রুকাইয়া, কুলসুমা ও জান্নাত-নেত্রী ফাতেমারা। তাদের কথা না-হয় থাক আপাতত। কোরাইশরা কাবায় কী করছে দেখে আসি।
কাবা শরিফের কিনারায় কোরাইশ নেতারা৷ পরামর্শ সভা বসেছে। কাবার দেয়ালে চিড় ধরেছে। দুদিন আগে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়েছিল এক মহিলা। সেখান থেকে গিলাফে আগুন লেগে যায়। গিলাফ পুড়ে গেছে। সাথে দুর্বল হয়েছে দেয়ালও। পাশের পাহাড় থেকে বর্ষার পানি এসে ডুবিয়ে যায় মাঝে মাঝে। সংস্কারের সময় এসে গেছে। সংস্কার করা যায় কিনা? করলে কীভাবে করবে—এই নিয়ে পরামর্শ।
একজন বললো, পুরোনো দেয়াল ভেঙে নতুন করে বাঁধতে হবে। অপরজন আপত্তি জানালো। বললো, খোদার ঘরে হাত দেয়া ঠিক হবে না। দেখতে পণ্ডিত সাদা দাড়িওয়ালা একজন দাঁড়িয়ে গেল। আগেরজনের আপত্তির জবাবে লম্বা ইতিহাস টানলো। ভায়েরা, দেয়াল ভাঙা নিয়ে এত চিন্তিত হবার কিচ্ছু নেই৷ এর আগেও এটি বহুবার সংস্কার হয়েছে৷ প্রথমবার বানিয়েছিলেন ফেরেশতারা। তাঁরা এটিতে তাওয়াফ করত। তখন মানুষ ছিল না। ছিল জিন জাতি। এরপর এটিকে সংস্কার করেছেন পৃথিবীর প্রথম মানব, আমাদের আদি-পিতা আদম আলাইহিস সালাম। তারপর করলেন তাঁর পুত্র শীস আ.। নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনের সময় সেটি ধ্বসে যায়৷ ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সময়ে এসে পুননির্মাণ হয়। ঐ যে পাশের সিনাই, যাইতা, লুবানন, জুদি, হিরাপর্বত দেখছেন, সেগুলো থেকে ফেরেশতারা পাথর এনে দিতেন৷ পুত্র ইসমাইল উপরে তুলে দিতেন। নবি ইবরাহিম গাঁথুনি দিতেন৷ মকামে ইবরাহিমটা তখন লিফটের মতো প্রয়োজনানুসারে উপর আর নিচে উঠা-নামা করত। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সেই ভিত এখনো টিকে আছে। তবে এটিতেও আমলেকা সম্প্রদায়, জোহরোম গোত্র ও কুসাই বিন কিলাব সংস্কার সাধন করেছেন। সুতরাং, পুরোনো হয়ে যাওয়া দুর্বল দেয়াল ভেঙে নতুন দেয়াল তৈরিতে বাধা নেই।
কোরাইশরা এই জ্ঞানী লোকটির কথায় ঐক্যমত্য হলো। কিন্তু কাবার দেয়াল ভাঙতে সাহস হচ্ছিল না কারো। ওয়ালিদ বিন মুগিরা এগিয়ে আসলো। উপর দিকে তাকিয়ে বললো, “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না। কেননা, আমাদের উদ্দেশ্য ভালো।” অতঃপর, সে পাথর সরাতে লাগলো। বাকিরা তখনও দর্শক। একজনের সতর্কতামূলক মতামত: চল, আমরা আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি। যদি দেখি, মুগিরার কিছু হয়নি; তবে আমরাও কাজ শুরু করবো।
পরদিন সবাই এসে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে। মুগিরার হাত-পা চারটা একই সাথে কাজ করছে! তার কিছুই হয়নি। কোরাইশরা আশ্বস্ত হয়। না, এ কাজে আল্লাহ রাজি আছেন। এবার সবাই হাত লাগায়। পাথর সরাতে থাকে। দেয়াল ভাঙতে থাকে। ভাঙতে ভাঙতে এক জায়গায় এসে থমকে যায় সবাই। কোদালের কোপ দিতেই পুরো মক্কানগরী কেঁপে ওঠে। পুরো পৃথিবী কেঁপেছিল কি-না কে জানে! সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ ভয়ে শুয়ে পড়ে। সাদা দাড়িওয়ালা আবার এগিয়ে এলো। চারিদিকটা ভালো করে পরখ করে। না, তোমরা আর গভীরে যেয়ো না। এটাই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গড়া মূলভিত্তি। এটার উপরেই আমাদের কাজ করতে হবে। লোকেরা বুঝতে পারে, ভাঙার কাজ শেষ, এবার গড়ার পালা৷ ভাঙলে গড়তে হয়। দুনিয়াটা ভাঙা-গড়ার বালুচর।
গড়ার কাজ শুরু। গোত্রগুলো নিজেদের ভাগ বুঝে নিল। দরজার পাশটা বানু আবদে মানাফ ও যুহরার। হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামেনির মাঝের স্থান বানু মাখযুম, পিছের অংশ বানু সাহম ও জাহম। হাতিমের অংশ বানু আবদুদ দার ও আদির। রাত-দিন কাজ চলে নাগাতার। সময় ভাগ করে সহযোগী গোত্ররাও কাজ চালিয়ে যায়। হেরা, সাবির, হালহালা থেকে পাথর এনে গাঁথুনি চলে। গড়নে আসে সামান্য ভিন্নতা। দেখতে দেখতে মূল ভিত্তি থেকে উপরে উঠলো আঠারো হাত। আগে ছিল নয় হাত। উচ্চতা আগের দ্বিগুণ। এবার থামা যাক।
দরজা লাগাতে হবে। সুখবর আসে লোহিত সাগর থেকে। মক্কা থেকে তার দূরত্ব ১২০ কি.মি.। সেখানে রোম থেকে আসা একটি জাহাজ ভেঙে খানখান হয়েছে। সেটির কাঠ-লোহা বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। কোরাইশ নেতারা ছোটে যায় দ্রুত। জাহাজের বিরাট কাঠখণ্ড কিনে দরজার জন্য। সাথে সেখানকার মিস্ত্রিকেও নিয়ে আসে। এক কাঠে পুরো দরজা শেষ। জোড়া-তালি নাই। আগে ছাদ ছিল না। এবার ছাদ হলো। ছয়টি খুঁটিতে সে ছাদ দাঁড়িয়ে।
সব কাজ শেষ। কাবাঘর লাভ করলো নতুনত্ব। ‘হাজরে আসওয়াদ’টা এখনো লাগানো হয়নি। হাজরে আসওয়াদ মানে কালো পাথর। পাথরটি জান্নাতি। নাম ইয়াকুত। ছিল ধবধবে সাদা। পাপীর পাপ পরিশোধন করতে করতে হয়েছে কালো। নাম হয়ে যায় কালো পাথর। এনেছিলেন ফেরেশতারা। সেই আদম আলাইহিস সালামকে পাঠানোর সময়। নবি ইবরাহিম আলাইহিস সালাম লাগিয়েছিলেন কাবার পূর্বকোণে। সেই মর্যাদাপূর্ণ পাথর কাবায় স্থাপন করা হবে। কিন্তু কে করবে এ কাজ? কাবা নির্মাণের সবচে’ সম্মানিত কাজের সম্পাদক হবে কে?
কোরাইশের গোত্র সব দাঁড়িয়ে
দেয় হাত বাড়িয়ে,
আমিই করব, আমিই করবো—
অন্যদের হারিয়ে।
সবাই সবাইকে হারাতে চায়। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার মোক্ষম সুযোগ। হাতছাড়া করা বোকামি। তুমুল তর্ক শুরু—আমি আর আমার গোত্র সেরা। চললো নাগাতার চারদিন। বন্ধের সম্ভাবনা ক্ষীণ। যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করল। পুরোনো নেশা জেগে উঠলো আবার। রক্তে হাত ডুবিয়ে শপথ নেয় একে একে। রণ-হুঙ্কার ঐ শোনা যায়...
পুণ্যে যা শুরু পাপে তার বিনাশ। বৃদ্ধ উমাইয়ার মন মানে না। খেলাতে খেলাতে মাথায় খেল এলো। সবার প্রতি শেষ আহ্বান: ওহে তোমরা থামো। বড় পুণ্য কামিয়েছো সবে। শেষকালে তার জলাঞ্জলি দিচ্ছো কোন কারণে। এ চরম ভুল। এ চরম লঙ্ঘন। শোনো কী বলি—আগামীকাল সবার প্রথম যে কাবার দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে, তার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেব। সে যা বলে তাতে সম্মত হব। বৃদ্ধ উমাইয়া বুদ্ধিতে সবার শুদ্ধি ফিরল। এ যুক্তিতে হয়ত মুক্তি মিলবে—এ আশায় পরদিন সকালের অপেক্ষা...
হুদহুদ পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে কাবা-বাসীর। একে একে জড়ো হয় কাবার পাশে। হেরেমের দুয়ারে সবার চোখ। কে আসবে? এই রণ-হুঙ্কার কে থামাবে? কী-ই বা দিবে সমাধান? নানান জল্পনা-কল্পনা। দেখতে দেখতে এক যুবকের আগমন। আধাঁরের বিদারণ। আলোর দেখা। ঝলমলে চেহারার যুবককে দেখে সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলো—
“হা-জা মুহাম্মদ, হা-জা মুহাম্মদ! আল-আমিন, আল-আমিন! রাদ্বি’না-হু, রাদ্বি’না-হু। হা-জা মুহাম্মদ, হা-জা আল-আমিন!”
“আরে, এই তো মুহাম্মদ এই মুহাম্মদ! পরম বিশ্বস্ত, পরম বিশ্বস্ত! তাঁর সিদ্ধান্তে আমরা রাজি, আমরা রাজি। এ তো মুহাম্মদ, পরম বিশ্বস্ত, পরম বিশ্বস্ত!”
উমাইয়া এগিয়ে আসলো। বাবা, তুমি এসেছো? বেশ ভালো হয়েছে, বেশ ভালো হয়েছে। মনে হয়, আল্লাহই তোমাকে আমাদের জন্য পাঠিয়েছে। হাজরে আসওয়াদ স্থাপনে বেশ ঝামেলা বেঁধেছে। তুমি একটা সমাধান দাও। সবাই তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।
কিছুক্ষণ সবকিছু স্তব্ধ। পিঁপড়ের হাঁটার শব্দও শোনা যাচ্ছে। আল-আমিন গায়ের চাদরটা মাটিতে রাখলেন। সেটার উপর রাখলেন হাজরে আসওয়াদ। আহ্বান জানালেন— এবার গোত্রপ্রধানরা এগিয়ে আসুন। চাদরের কোণায় ধরে এটিকে তুলুন। গোত্রপ্রধানদের সম্মিলিত শক্তিকে পাথর উপর ওঠলো। এবার এগিয়ে চলুন। যেতে যেতে কাবার পূর্বকোণা। হয়েছে, থামুন। এবার পাথরটিকে তিনি হাতে তুলে নিলেন। লাগিয়ে দিলেন যথাস্থানে! অতঃপর অনুরাগভরে সেটার উপর দীর্ঘ চুম্বন! চারিদিক থেকে করতালির আওয়াজ আসছে—
ওরে সত্যব্রতী আল-আমিন,
করলে এ কী সংজ্ঞাহীন!
এক চাদরে সবারে শামিল
সাম্যবাদের এ কোন বীণ!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন