সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিকেলের মিশেল

বিকেলের মিশেল

শুয়ে থাকতে থাকতে বড্ড বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। কতক্ষণই বা শুয়ে থাকা যায়? বিকেলটায় দুয়েক কদম হাঁটাহাঁটি না-করলেই নয়। গ্রাম হলে তো রীতিমতো আয়োজন করে হাঁটা চাই। যেখানটাই আছি এটা আক্ষরিক অর্থে গ্রাম। অজপাড়াগাঁ বললেও চলে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়া যে লাগেনি তা না। মাটির মাদরাসাটি তিনতলার পাকা ভবনে দাঁড়িয়ে গেছে। মেটোপথে ইট এসে জড়ো হয়েছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। তার কল্যাণে টেলিভিশন, ডিস এন্টেনা এখানেও বিস্তার লাভ করেছে বেশ আগেই। অধিকাংশ মাটির ঘরও পোড়ামাটির ইটে খেয়ে নিয়েছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে দুয়েকশ কদম হাঁটলেই টিলার সারি। ছোট ছোট টিলায় ঘেরা পশ্চিমটা। আগেকার দিনে মাগরিবের আজানের সাথে সাথে শিয়ালের ‘আক্কা হুয়া’ ধ্বনিও শোনা যেত ঘরে বসে। এখন আর শোনা যায় না। মানুষের অতিরিক্ত আধিপত্যে তাদের জাতের বিলুপ্তি ঘটে গেছে। এখান থেকে যত পশ্চিমে যাবেন, টিলার উঁচুত্ব আর ঘনত্ব ক্রমে বাড়তে থাকবে। সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম হবে না।

সে যাই হোক, বের হলাম হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিমে কিছুটা যেতেই এলাকার প্রধান সড়ক। সেটা টপকাতেই ধানক্ষেতের সারি। শীষ বেরিয়েছে মাত্র। ধান থেকে ফুল ঝরেনি এখনো। অপরূপ দৃশ্য। মনে হলো আসলেই—ধন ধান্যে পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা। হালকা ছোঁয়ে দিলাম। না, দেখতে সুন্দর হলেও কোমলতা নেই। একটু কর্কশ। উদ্দীপ্ত যৌবনে সবকিছু দুমড়েমুচড়ে ফেলার মতো ভাব। সুকান্ত হলে বলতেন, ‘এ বয়স মাথা নোয়াবার নয়’।

ধানক্ষেত্রের সাথে পিরিতি জমলো না। সৌন্দর্য দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। হালকা বামে বেঁকে সামনে এগোলাম। এগোতে এগোতে গিয়ে পড়লাম সবজি ক্ষেতে। আলু, শিম, মরিচ, বরবটি কোমড়াসহ নানান জাতের সবজি ক্ষেত। মরিচ, বরবটি, শিমের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। রান্না হওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। আলুর কথা বলতে পারি না। মাটির নিচে লুকিয়ে আছে। ছোটবেলায় ভোলার সাথে আলু তোলার সময় সে বলেছিল, তুলবেই যখন, এগুলোকে গাড়লে কেন? সৌন্দর্য দেখে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম আর এগোচ্ছিলাম। এক জায়গায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম৷ সবুজ ঘাসে হাত বুলাতে থাকি। এককালে এগুলিকে পরম যত্নে কাঁচি দিয়ে কেটে গরুকে খাওয়াতাম। কোদাল দিয়ে তুলে পানিতে ধুয়ে খোঁয়াড়ে দিতাম। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরুর জাবর কাটা দেখতাম।

সবুজ ক্ষেত, ঘাস, আর চিরচেনা মাটিগুলো আমায় বরণ করলো। চিরচেনা বলছি, কারণ ছোটবেলায় এখানটায় নিয়মিত আসা হতো। বাপ-ভাইরা ক্ষেতি ছিলেন। সাহায্যের জন্য সাথে করে নিয়ে আসতেন আমাকেও। কাজ কী কী করতাম, তা মনে নেই অতটা। তবে যথেষ্ট বাড়াতাম—এটা হলফ করেই বলতে পারি। মাটির গন্ধ শোঁকে দেখলাম আগের মতোই আছে। সেই মোহনীয় ঘ্রাণ। ক্ষিঞ্চিৎ আয়েশ জাগলো—বুকের সাথে বুক মিলিয়ে নিই। আইলের মাঝেই শুয়ে পড়লাম। ঘাসগুলো বেডসিট হয়ে কাজ করছে। আহ! আমার বাংলা মায়ের মাটি। কত খাঁটি, কত খাঁটি! চোখ বুজে তারে বুকে মাখি। আমার বাংলা মায়ের মাটি।

আরেকটু সামনে টিলার পাদদেশ। টিলাগুলো সেকালে বেশ বড় মনে হতো। এখন দেখি, অতটা বড় না। দৃষ্টিশক্তি বড় হয়েছে, নাকি টিলা ছোটো হয়েছে কে জানে! গ্যালাক্সি দেখার তাড়ায় উপগ্রহে আর অতটা নজর যায় না বিজ্ঞানিদের। আমি বিজ্ঞানী না। নিভৃতচারী। গ্যালাক্সি দেখার স্বাদ না-থাকলেও হিমালয় দেখার স্বাদ আছে। তাই হয়ত এ দৃষ্টিবিভ্রম। আরেকটু সামনে আগাতেই পরিচিত খালটি। বর্ষার বর্ষণে এর যৌবনলীলা কূল বেয়ে উপচে পড়ে। এখন প্রায় শুকনো। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা বাঁধ বেঁধে মাছ ধরছে। একসময় আমিও ধরতাম। কোমরে গোঁচ মেরে, গায়ের গেঞ্জি মাচায় তুলে দিনকে দিন পড়ে থাকতাম খালে আর বিলে।

সে-সময়কার ছেলেপেলে স্বভাবতই ওরকম ছিল। এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। যে মানুষগুলোকে পাঁচমিনিটের জন্য ঘরে বেঁধে রাখা যেত না, স্মার্টফোন আর নেট দুনিয়ার কল্যাণে তারা আজ ঘর থেকে বেরোতে ভুলে যায়। অঘোষিত কোয়ারান্টাইন পালন করে সারা বছর। সে যাই হোক, সূর্য ডুবে ডুবে ভাব। তার চেহারায় কোন দুষ্টু মেয়ে হোলিখেলার লাল রঙ মেরে দিয়েছে। বেশিক্ষণ এখানে থাকলে আমার মুখেও এসে পড়তে পারে। বাড়ি ফেরা যাক...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...