সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জামাআত বন্ধ প্রসঙ্গে

হারাম ও নববী শরিফে জামাআত বন্ধ: মুসলমানদের কঠিন পরীক্ষা ও ইমানি দুর্বলতা

বিষুদবারের ঘটনা। আত্মার টানে ভাণ্ডার শরিফ গেলাম। ভাণ্ডার শরিফ বলতে মাইজভাণ্ডার দরবার। আমার প্রশান্তির ঠিকানা। অনুরাগের আতুড়ঘর। উত্তাল হৃদয়ের শান্তির বাতিঘর। গিয়েছিলাম শহর থেকে। পুরো পথ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এই বুঝি করোনা ধরলো। বাতাসটা কেমন যেন ভারি ভারি। করোনা বুঝি হাত-পা ছড়িয়ে ওড়ছে। পাশের মানুষটাকে আজরাইল মনে হচ্ছিল। এই বুঝি করোনা লাগিয়ে দিয়ে জান কবজ করবে। আতঙ্কে গা শিরশির করে উঠে মাঝেমধ্যে। পুরো নাক-মুখ ঢেকে দিয়েছি রুম থেকে বের হওয়ার পরপরই। অচেতন লোকালয়ে আমি আজব এক সচেতন লোক।

সারা পথ এভাবেই কাটলো। সর্বোচ্চ সচেতনতায়। ভাণ্ডারের শাহি গেইটে গিয়ে উপস্থিত। পাদুকাজুড়া খোলে নিলাম। এই পথে অলি-আল্লাহদের আনাগোনা। গাউছ-কুতুবের হাট এটা। জুতা পায়ে হাঁটি কী করে? সাথে নাক-মুখ একেবারে উন্মুক্ত করে দিলাম। ওরে নাক, ওরে মুখ—নে, ভাণ্ডারির মুক্ত বাতাস নে৷ এ পথের ধুলি টেনে পেট ফুলিয়ে ফেল। এসব ওষুধ, এসব নিরাময়। করোটা-টরোনার চৌদ্দগোষ্ঠী পালাবে। এই করে করে হাঁটছি আর ভাবছি—এতক্ষণের আগাগোড়া সচেতন মানুষটার এত পাগলামি এল কোথা থেকে৷

দেখতে দেখতে আরেক পাগল সামনে পড়লো। উসকোখুসকো চুল। গায়ে ছেঁড়াফাটা কাপড়। হাতে লাঠি। অনবরত বকে চলেছে—“হযরত কেবলা আর বাবাজান কেবলা টাকার ক্ষণি। যে চায়, সে পায়।” বুঝছি। আমাকে বলদ বানানোর চেষ্টা চলছে। পরীক্ষা করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইদানীং চাওয়া-টাওয়া বাদ দিয়ে কেবল বসে থাকি তো, তাই টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে। বুঝে ফেলতে দেরি পাগলা গায়েব হতে দেরি নেই। এদিক সেদিক বহু খুঁজলাম। না, পাত্তা নেই। বাদ দেই, খোঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। সময় এলে অটোমেটিক সামনে আসবে৷ পাগলাটারে মাঝেমাঝেই দেখি। একদিন দেখেছিলাম হযরতের রওজার পশ্চিম পাশে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনবরত সুরা ইয়াসিন পড়ছে। আমি একনজরে তাকিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর ধমক দিয়ে বললো—যাঃ, ভেতরে ঢুক। তৎক্ষণাৎ ঢুকে পড়েছিলাম।

অজু করে আজও ঢুকলাম। রওজা সোজাসুজি পশ্চিমে বসে পড়লাম। প্রথম কিছুক্ষণ চুপচাপ। এরপর জিকির শুরু। জিকির বলতে “ইয়া হযরত”। এটাই পড়া হয়। ওখানে আর কি-ই বা পড়বো। সুরা ফাতিহা-ইখলাস পড়ে সাওয়াব পাঠাবো? কার কাছে কেন পাঠাবো? উত্তর নাই। তারচে’ ইয়া হযরত জপাই বেস্ট। তাতে যদি তিনি রাজি হন, সন্তুষ্ট হন, খুশি হন! করোনা মরোনার কথা মাথায় নেই৷ কে কোনদিক দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে সে-সবের খবরও নেই। খবর আসলে নিজেরও নেই। হযরতের সামনে বসে নিজের খবর খুঁজবো—এত দুঃসাহস কি আমার থাকার কথা? কিছুদিন আগের লেখা গানটি অস্পষ্ট সুরে গাওয়া ধরলাম—
“বসে রই তাঁর পরশে
লুটে পড়ি ধ্যানের বসে
কে মজে কোন রঙ্গরসে
তার তো হিসেব রাখি নাই।”

নিজের লেখাগুলো নিজের মুখস্থ থাকে না। পড়তে পড়তে কখন যেন পুরোটা পড়ে ফেললাম। মিরাকল! এখানে এভাবেই মাঝেমধ্যে ঘটে যায়। ঘটা আরম্ভ করলো৷ এটা শেষ করে বজলুল করিম মন্দাকিনীর “কে তুমি হে সখা” ধরলাম। একে-একে হাদি, রমেশেও পার হলো কিছুক্ষণ। অন্তরে প্রশান্তি এলো। হৃদয়ঝড় থামলো। তার মানে আজকের কাজ শেষ। এবার বের হ৷ বাবা ভাণ্ডারিকে প্রণাম করে বাড়ি যা। ঠিক আছে। আপনার মর্জি। আমার কী। বের হয়ে বাবা ভাণ্ডারি কেবলাকে প্রণাম করে নিলাম।

ক্ষিধে বেটা ছুঁ মেরে পেটে প্রবেশ করলো। ঢুকলাম হোটেলে। রুটি দেন, ডালাভাজি দেন। খেলাম গোগ্রাসে। এর আগের ঘটনা কিন্তু উল্টো। রাস্তার পাশের চা খাইনি ভয়ে ভয়ে। যদি দোকানদার আক্রান্ত হয়। তার হাত থেকে কাপে, কাপ থেকে আমার হাতে! কী ভয়ঙ্কর! আর এখন? ভয়টয় সব উধাও। ভয়ের কথা আর কী বলবো? আরেকটু সামনে যাই। বাদশা ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ। ভদ্রলোক মজার মানুষ। ‘মোলাকাত না-করার পোস্ট’ দেয়ার পর থেকে আমাকে খুঁজছে—একবার জড়িয়ে ধরবে বলে! এসে ঝাপটে ধরলোও। বাধা দিলাম না। আরে ভয় কীসের? আমি তো ভাণ্ডারে আছি। এখানে করোনা আসলেও আমার কচুটিও করতে পারবে না। একটু আগে হযরতের রওজার পানি খেয়েছি না? ঐ পানি তো কেবল পানি না, আমার কাছে অমৃত! ঐগুলি তো এখনও পেটেই। এই পানির কাছে করোনা-টরোনা তো মামুলি ব্যাপার।

অনেকক্ষণ ভাণ্ডারে ঘুরলাম। এবার মক্কা-মদিনায় যাই। হেরেম আর নববিতে। বলছিলাম বিশ্বাসের কথা। ভাণ্ডার আমার বিশ্বাস। আমার প্রতিটি নিশ্বাস ভাণ্ডারির নাম জপে৷ যতক্ষণ আমার হাত ভাণ্ডারির কদমে আছে, ততক্ষণ সারা পৃথিবী উল্টালেও আমার কিছুই হবে না। আপনি পাগলামি বলতে পারেন; কিন্তু এটাই আমার বিশ্বাস। এ বিশ্বাস হিমালয়ের মতো দৃঢ়। ঠিক এই জায়গায় থামা যায়। বিশ্বাসের জায়গাটাতে। ভাণ্ডারের প্রতি আমার যে বিশ্বাস, পুরো বিশ্ব-মুসলিমের কাছে মক্কা-মদিনা ঐ লেভেলের বিশ্বস্ত স্থান। এরচেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি বলতে পারেন।

সারা পৃথিবী উল্টাতে পারে, মুমিনদের বিশ্বাস থেকে মক্কা-মদিনা উল্টাতে পারে না। আরে, এটা তো সেই মক্কা-মদিনা, যার জন্যে মুসলমানরা গর্দান দিতে ভয় করেনি৷ লড়েছে ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্কর শত্রুদের সাথে। সে জায়গায় সামান্য এ ভাইরাস তেমন কী? বিশ্ব মুসলিম-মুমিন শোনো। হেরেম আর নববিতে জামাআত বন্ধ হওয়া মামুলি কিছু না। এটা বিশাল ভুল পদক্ষেপ। বিশ্ব-মুসলিমদের উপর চলতে থাকা সৌদ-সরকারের জুলুমের একটি অংশ। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া চাই। একে প্রতিরোধ করা চাই। আরে, নবিজির থুথুতেও মহামারি পালাতো। এখন নবিজি স্বয়ং নববিতে শুয়ে আছেন। এতেও ভয়? কীসের? ঘরে বসে থাকার চেয়ে মুসলমানদের হারাম-নববিতে গিয়ে মরে যাওয়া শ্রেয় নয় কি? মসজিদে হারাম ও নববির গেইট খোলে দেয়া হোক। আমরা আর গজব চাই না। মুসলমানরা মনভরে তাওয়াফ করে মরে যাক। নবিজির জেয়ারত করে মরে যাক। তাওয়াফ, জিয়ারত, নামাজবিহীন মুসলমানে পৃথিবী সয়লাব করার দরকার কী?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...