প্রশংসিত-৬
খাদিজা সাত রাজার ধন পেয়ে বসেছে। সাত না; রাজাদের রাজার ধন। আরে না, স্বয়ং রাজা পেয়ে বসে আছেন। খাদিজা থেকে খাদিজাতুল কুবরা হয়েছেন। তাঁর আর সম্পদ চায় না। চায় শুধু প্রেমাস্পদের ভালোবাসা-সন্তুষ্টি। সব সম্পদ প্রেমাস্পদের পদতলে উজাড় করে দেন। নব-দোলহা রাতারাতি সম্পদশালী। কিন্তু এ সম্পদ তিনি কী করবেন? তিনি তো বিলাতে এসেছেন, ভোগ করতে নয়। কার মেয়ের বিয়ে আঁটকে গেছে, কোন গরীব না-খেতে পেয়ে মরছে, কোন বিধবা সম্বলহীনা, কার মাল দস্যুরা লুটে নিয়েছে—খোঁজে খোঁজে দান করা শুরু। পৃথিবীময় প্রসারিত এ হাত—দানে থামে না। ফকির হওয়ার ভয় করে না। কমে যাওয়ার চিন্তায় মজে না। পরম দাতা যাঁর সাথে, কমার ভয় কি তাঁর সাজে?
সাজে না। সাজা থেকে সাজগোজ। ওসবের বালাই ছাট। পূর্ণ যুবক। টগবগে চেহারা৷ মাথায় বাবরি চুল। দেখতে মাঝারি গড়ন। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে দূর থেকেও দেখা যায়। পুরো মক্কার মধ্যমণি এখন। আল-আমিন নামের প্রচার আরো প্রসারিত হয়েছে। ঘোড়ায় চড়লে তাঁকে আর থামায় কে? হ্যা, ঘোড়ায় এখন চড়া হয় নিয়মিত। সিরিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল খাদিজার। সে-সবের দেখাশোনা এখন নিজেকেই করতে হয়। গোত্রের দশজনের একজনও বটে। মধ্যমণি বলেছিলাম। তাঁকে ছাড়া আসর জমেই না।
কিন্তু আসরে তাঁর মন মজে না। নিরালা ভালো লাগে৷ কিছু সময় একাকী অনন্ত সত্তার সন্ধানে না-কাটালেই নয়। তাই সুযোগ পেলেই ছোটে চলেন বিজনভূমে। লোকালয়ের অন্তরালে। পরম আরাধ্যকে খোঁজে বেড়ান বন থেকে বনান্তরে।
দেখতে দেখতে খাদিজার কোলও পূর্ণ হয়। বিয়ের দুবছর পর জন্ম হয় নবিজাদা কাশেমের। দুবছর পর মারাও গেলেন। পরের বছর আবার আলোর দেখা। বিবি জয়নবের জন্ম। জন্ম হয় কাশেম, তৈয়ব, তাহেরেরও। কিন্তু বিধির বিধান। শেষনবির পুত্র রবে না। সবাই মারা যায় অল্পবয়সে। তাঁর কাঁধে পুরো দুনিয়ার সন্তানদের ভার। চারপু্ত্রের বাড়তি ভার চাপিয়ে দেবেন কেন? এই কি হেকমত? এই কি রহস্য? জানা নেই। রহস্য রহস্যই থাক। পুত্রহারা খাদিজার কোল পুত্রশোকে বিভোর হতে দেননি। একে-একে দুনিয়া আলোকিত করেছেন, রুকাইয়া, কুলসুমা ও জান্নাত-নেত্রী ফাতেমারা। তাদের কথা না-হয় থাক আপাতত। কোরাইশরা কাবায় কী করছে দেখে আসি।
কাবা শরিফের কিনারায় কোরাইশ নেতারা৷ পরামর্শ সভা বসেছে। কাবার দেয়ালে চিড় ধরেছে। দুদিন আগে মোমবাতি জ্বালাতে গিয়েছিল এক মহিলা। সেখান থেকে গিলাফে আগুন লেগে যায়। গিলাফ পুড়ে গেছে। সাথে দুর্বল হয়েছে দেয়ালও। পাশের পাহাড় থেকে বর্ষার পানি এসে ডুবিয়ে যায় মাঝে মাঝে। সংস্কারের সময় এসে গেছে। সংস্কার করা যায় কিনা? করলে কীভাবে করবে—এই নিয়ে পরামর্শ।
একজন বললো, পুরোনো দেয়াল ভেঙে নতুন করে বাঁধতে হবে। অপরজন আপত্তি জানালো। বললো, খোদার ঘরে হাত দেয়া ঠিক হবে না। দেখতে পণ্ডিত সাদা দাড়িওয়ালা একজন দাঁড়িয়ে গেল। আগেরজনের আপত্তির জবাবে লম্বা ইতিহাস টানলো। ভায়েরা, দেয়াল ভাঙা নিয়ে এত চিহ্নিত হবার কিচ্ছু নেই৷ এর আগেও এটি বহুবার সংস্কার হয়েছে৷ প্রথমবার বানিয়েছিলেন ফেরেশতারা। তাঁরা এটিতে তাওয়াফ করত। তখন মানুষ ছিল না। ছিল জিন জাতি। এরপর এটিকে সংস্কার করেছেন পৃথিবীর প্রথম মানব, আমাদের আদি-পিতা আদম আলাইহিস সালাম। তারপর করলেন তাঁর পুত্র শীস আ.। নূহ আলাইহিস সালামের মহাপ্লাবনের সময় সেটি ধ্বসে যায়৷ ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সময়ে এসে সেটির পুননির্মাণ হয়। ঐ যে পাশের সিনাই, যাইতা, লুবানন, জুদি, হিরাপর্বত দেখছেন, সেগুলো থেকে ফেরেশতারা পাথর এনে দিতেন৷ পুত্র ইসমাইল উপরে তুলে দিতেন। নবি ইবরাহিম গাঁথুনি দিতেন৷ মকামে ইবরাহিমটা তখন লিফটের মতো প্রয়োজনানুসারে উপর আর নিচে উঠা-নামা করত। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সেই ভিত এখনো ঠিকে আছে। তবে এটিতেও আমলেকা সম্প্রদায়, জোহরোম গোত্র ও কুসাই বিন কিলাব সংস্কার সাধন করেছেন। সুতরাং, পুরোনো হয়ে যাওয়া দুর্বল দেয়াল ভেঙে নতুন দেয়াল তৈরিতে বাধা নেই।
কোরাইশরা এই জ্ঞানী লোকটির কথায় ঐক্যমত্য হলো। কিন্তু কাবার দেয়াল ভাঙতে সাহস হচ্ছিল না কারো। ওয়ালিত বিন মুগিরা এগিয়ে আসলো। উপর দিকে তাকিয়ে বললো, হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন না। কেননা আমাদের উদ্দেশ্য ভালো। অতঃপর, সে পাথর সরাতে লাগলো। বাকিরা তখনও দর্শক। একজনের সতর্কতামূলক মতামত: চল, আমরা আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি। যদি দেখি, মুগিরার কিছু হয়নি; তবে আমরাও কাজ শুরু করবো।
পরদিন সবাই এসে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে। মুগিরার হাত-পা চারটা একই সাথে কাজ করছে! তার কিছুই হয়নি। কোরাইশরা আশ্বস্ত হয়। না, এ কাজে আল্লাহ রাজি আছেন। এবার সবাই হাত লাগায়। পাথর সরাতে থাকে। দেয়াল ভাঙতে থাকে। ভাঙতে ভাঙতে এক জায়গায় এসে থমকে যায় সবাই। কোদালের কোপ দিতেই পুরো মক্কানগরী কেঁপে ওঠে। সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কেউ কেউ ভয়ে শুয়ে পড়ে। সাদা দাড়িওয়ালা আবার এগিয়ে এলো। চারিদিকটা ভালো করে পরখ করে। না, তোমরা আর গভীরে যেয়ো না। এটাই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গড়া মূলভিত্তি। এটার উপরেই আমাদের কাজ করতে হবে। লোকেরা বুঝতে পারে, ভাঙার কাজ শেষ, এবার গড়ার পালা৷ ভাঙলে গড়তে হয়। দুনিয়াটা ভাঙা-গড়ার বালুচর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন