সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মেরাজ

গভীর_রাতে_এ_কোন_যাত্রা...

মুহাম্মদ সৈয়দুল হক

#পর্ব১
গভীর রাত। পৃথিবী ঘুমন্ত। গাছের পাতাও নড়ছে না। ঝিঁঝি পোকার ডাক বন্ধ হয়েছে বহু আগে৷ ধুলিবালিরাও স্থান করে ঘুমিয়েছে। সব ঘর আলোহীন৷ দরজায় খিল লাগানো। একটা ঘর এখনো জেগে। পাশে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। ঘরের নাম কাবাঘর। এই ঘর ঘোমায় না। চির জাগ্রত। কাবাঘরের পশ্চিমে আরেকটি ঘর। ওটা উম্মে হানির। উম্মে হানির রসুলুল্লাহর দুধবোন। চাচা আবু তালিবের কন্যা। তার ঘরে নবিজি ঘুমুচ্ছেন। ঘুমুচ্ছেন কি ঘুমিয়ে ঘুমকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কে জানে! সামনে ব্যস্ত পথ। বহুদূর যেতে হবে। একটু বিশ্রাম...

চিলের মতো ছোঁ মেরে জিবরাইলের আগমন৷ এসে পড়লেন দ্বন্দ্বে। নবিজি ঘুমুচ্ছেন। নিয়ে যাবার নির্দেশ আল্লাহর। কোথায় নিয়ে যাবার সেটা পরে বলছি। আগে জিবরাইলের কাণ্ডটা একটু দেখি৷ আস্তে আস্তে পায়ের গোড়ায় গেলেন। বসে চুমু খেতে লাগলেন তালুতে। আহ, জিবরাইল, আপনি কত ভাগ্যবান গো, আপনি কত ভাগ্যবান! সুযোগ পেলে আপনার কপালে কপালটা ঘসে নিতাম।

মেরাজ-রাজ জাগলেন। “ও, আপনি এসেছেন?”
—জী, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তাআলা আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন। সালামুন আলাইকুম। অনুমতি পেলে আরজ করতাম!
—বলুন, বলুন। আল্লাহ কী খবর পাঠিয়েছেন?
—জী, আজ আর খবর না। আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। আপনাকে যেতে হবে।
—সে কী, কোথায়?
—ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া, খোদার আসন আরশ ছেদিয়া। আরো উপরে, আরো বহুদূর। কত উপরে, কত দূরে জানা নেই।
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। খোদা তায়ালার দাওয়াত। চলুন, দেরি করা ঠিক হবে না।

বুরাক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিল। বুরাক স্বর্গীয় জীব। গাধার চেয়ে উঁচু। খচ্চরের চেয়ে খাটো। চেহারা মানুষের মতো৷ উটের মতো পা। পিঠের কেশগুচ্ছ পশমি ঘোড়ার মতো। তার বহুদিনের স্বপ্ন পুরণ হতে চললো। একটু পর নবিজিকে নিয়ে উড়াল দেবে। বেহেশতে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছিল—শেষনবিকে মেরাজে আনতে বুরাকদের মধ্য থেকে একটাকে বাছাই করা হবে৷ মোটাতাজা বুরাকগুলো খুশিতে তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছিল৷ এই মিয়া বসে বসে কান্দে। চোখে দাগ ফেলে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়। শুকনা থেকে আরো শুকনা হয়। স্বাস্থ্য ভাঙে। দুর্বল থেকেও দুর্বল হয় দিনদিন।

জিবরিল এসে জিজ্ঞেস করেন, কিরে কান্দস ক্যান?

—কাঁদি কি আর স্বাদে? সবাই দেখুন কত মোটাতাজা। আমি তো স্বাস্থ্যহীন। রোগা-পাতলা। শক্তিহীন। আমাকে তো নেয়া হবে না। রাহমাতুল্লিল আলামিনকে দেখার বড়ো ইচ্ছে। তাঁর উচিলায় যে আমি বুরাকের জন্ম। তাঁর সামান্য খেদমত যদি করতে পারতাম! আহহহ! সে আশা আর পূর্ণ হলো না। জনমের স্বাদ অপূর্ণই রয়ে গেল!
—চল তবে, তোকেই নিয়ে যাই। আল্লাহ তোকে নির্বাচন করেছেন—এই বলে বুরাকের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মুহূর্তে সে সবার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তার ঔজ্জ্বল্য গ্রহগুলোর মাঝে সূর্যের মতো হয়। অন্যরা যেন নজরেই আসে না।
—বাই দ্যা ওয়ে, একটি প্রশ্ন ছিল। আল্লাহ তায়ালা কী দেখে আমাকে পছন্দ করলেন? আমি তো সবার চেয়ে দুর্বল ছিলাম।
—প্রেম। তোর প্রেম তোরে জিতিয়ে দিয়েছেরে পাগলা। এই প্রেমের জোর কত জানিস? কণ্ঠহীন তোতলা কৃষ্ণকায় বেলালের আজান না-হলে সকাল হয় না। আবু বকরের সামান্য ছাই ওমরের অর্ধেক সম্পদকে হারিয়ে দেয়। তামাম সাহাবিদের ছাপিয়ে দূরদেশের ওয়াইস করনি জুব্বা পেয়ে বসে। সবি এই প্রেমের খেলা। প্রেমের জোরের সামনে সব জোর মেকিরে পাগলা, সব জোর মেকি। সব শক্তি বৃথা।

নবিজি বুরাকে চড়ে বসলেন। জিবরিল লাগাম ধরলেন। বুরাক চললো প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে। পিছে পিছে মিকাইল, ইসরাফিল। সাথে আরো সত্তর হাজার ফেরেশতা। জুলুস চলছে জুলুস—
“ছবছে আওলা ওয়া আ’লা হামারা নবি
ছবছে বা-লা ওয়া আ’লা হামারা নবি।”

বায়তুল মুকাদ্দাসে এসে বুরাক থামলো। সেখানে বিশাল জমায়েত। নবিগণ উপস্থিত। নবিজি গণসংবর্ধনায় সিক্ত হলেন৷ সবাই কাতারে দাঁড়ালেন। নামাজ হবে। নবিদের নামাজ। পৃথিবীতে এই প্রথম একসাথে। একই জামাআতে সব নবি উপস্থিত। সবাই তো নবি। ইমাম কে হবেন? ফিকহের ফতোয়া কী বলে? উপস্থিতির মাঝে যিনি সবার শ্রেষ্ঠ, তিনিই ইমাম। এখানে কে শ্রেষ্ঠ? বাবা আদম আছেন। তাঁকে সফিউল্লাহ বলা হয়েছে। বাবা ইবরাহিম আছেন। তাঁকে খলিলুল্লাহ বলা হয়েছে। নবি মুসা আছেন। তাঁকে কালিমুল্লাহ বলা হয়েছে। নবি ইসা আছেন। তাঁকে বলা হয়েছে রুহুল্লাহ। এভাবে সমস্ত নবি-রাসুল। একেকজনের একেক শান। মর্যাদায় স্বতন্ত্র। জিবরিল বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আপনি যান। কেননা আপনি রাসুলুল্লাহ! ইমামুল আম্বিয়া। নবিদেরও নবি৷ অন্যান্য নবিরা স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত। কিন্তু সব নবিদের সব মর্যাদা আপনার মাঝে পুঞ্জিভূত। নয়, এমন নয়, এইটুকু নয়। বরং সব নবি—যে যা পেয়েছে, যতটুক পেয়েছে; সব আপনার কাছ থেকেই পেয়েছে। হ্যাঁ, আপনি আজ অদ্বিতীয়। এখানটাই আপনার মতো দ্বিতীয় কেউ নাই। আপনিই আজকের ইমাম। সবাই আপনার পেছনেই ইকতিদা করবে। আল্লাহু আকবর!
“খলকছে আউলিয়া, আউলিয়া ছে রুসুল
আও রসুলু ছে আ’লা হামারা নবি।”

#পর্ব২
নামাজ শেষ। শেষ হলো কুশল বিনিময়। শুভকামনা জানিয়ে যে যার মতো বিদায় হলেন। মেরাজ শুরু। মিরাজ মানে ঊর্ধ্বভ্রমণ। বুরাক উড়াল দিলো। তার দ্রুতি কত? সে যতটুকু দেখতে পায়, এক লাফে ততটুকুই যায়। আলোর চেয়েও দ্রুত। এই দ্রুতির সামনে রকেট-মকেট তুচ্ছ। আসমানবাসীদের খুশি আজ কে দেখে! চাঁদ-তারারা নাচনে বুড়ি। ফেরেশতারা দিলো ঢুলের বাড়ি। ঢুলের তালে গান ধরেছে—
“দেখো আজ আরশে আসেন মোদের নবী কামলিওয়ালা
হের সেই খুশিতে চাঁদ-সুরুজ আজ হলো দ্বিগুণ আলা।” —নজরুল
বুরাকের থামাথামি নেই। একনাগাড়ে উড়ে চলেছে। নবিজিকে পিঠে নেয়ার পর তার শক্তি আরো কতটা বেড়েছে কে জানে! উড়ছে তো উড়ছেই। সবকিছু ছাপিয়ে। একে একে পেছনে পড়ছে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি। পেরিয়ে যাচ্ছে শত শত আলোকবর্ষ। আসমানের দূরত্ব কত খোদা-মালুম।

যেতে যেতে প্রথম আসমানে পৌঁছলেন। সেখানে আদম আলাইহিস সালাম উপস্থিত। নবিজিকে নতুনভাবে অভ্যর্থনা জানালেন। সৃষ্টির আদি নবিকে দুনিয়ার আদি নবির অভ্যর্থনা! সে অভ্যর্থনা কীরূপ, তার ভাষা-ভাবশৈলী কেমন জানা নেই! দীর্ঘ মোলাকাত শেষে বাবা আদম বিদায় জানালেন। গেলেন দ্বিতীয় আসমানে। সেখানে যাকারিয়া ও ইয়াহিয়া আলাইহিমুস সালাম। তারাও একইভাবে বিদায় জানালেন৷ এভাবে তৃতীয় আসমানে ইউসুফ, চতুর্থ আসমানে ইসা, পঞ্চম আসমানে হারুন এবং ষষ্ঠ আসমানে মুসা আলাইহিমুস সালাম—এর সাথে দেখা। পরস্পর সংক্ষিপ্ত আলোচনা৷

চলে গেলেন সপ্তম আসমানে। সেখানে সৈয়দেনা ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। বায়তুল মামুরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বায়তুল মামুর একটি মসজিদ। কাবা বরাবর সোজা উপরে। সপ্তম আসমানে অবস্থিত। দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা নামাজ পড়েন৷ নামাজ দেখছি দুনিয়াতে না; আসমানেও চলে। এখানে একবার যারা পড়েন, কিয়ামত পর্যন্ত দ্বিতীয়বার তাদের সুযোগ হবে না। তবে ফেরেশতার সংখ্যা কত?! সে যাই হোক, নবিজির আগমনে নবি ইবরাহিম আ. হুড়মুড়িয়ে উঠে স্বাগতম জানালেন। নবিজির ইমামতিতে আরো দুরাকাত নামাজ হলো। এবারের মোক্তাদি ফেরেশতা আর রুহ জগতের অসংখ্য রুহ।

পরের সফর জান্নাতে। নবিজি ধীরপদে এগোচ্ছেন আর জান্নাতিদের আরাম-আয়েশের নমুনা দেখছেন। ছোট ছোট মুক্তোর পাথর, মাটি মেশকের মতো সুগন্ধি। সেখানে চারটি নদী। পানি, দুধ, মধু ও শরাবের। শরাব বলতে বেহেশতি শরাব। দুনিয়াবি শরাব ভেবে মাতাল হবার কারণ নাই। পানি, দুধ, মধুর নহরগুলোও বেহেশতি। কত সুন্দর, কত সুস্বাদু, কত নির্মল—বর্ণনার অযোগ্য। নাম অজানা বহু ফলফলাদি। দুনিয়ার বুকের যাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। তারপর একে একে সিদ্দিকের আকবর, ওমর ফারুক, মা খাদিজার জন্য তৈরি অট্টালিকা, বেলাল রা.—এর পায়ের আওয়াজ। সবটা দেখলেন, শুনলেন, পর্যবেক্ষণ করলেন। কীভাবে সম্ভব—সে প্রশ্ন নিশ্চয় আজকের দিনে আর জাগার কথা নয়। বিজ্ঞানীদের একটি দল বেশ জোরেশোরে দাবি জানিয়েছেন টাইম-ট্রাভেল সম্ভব। টাইম-ট্রাভেল তো বুঝি? বিশেষ যন্ত্রে ভবিষ্যতে চলে যাওয়া। নবিজি মেরাজ-রাতে ভবিষ্যতেই চলে গিয়েছেন। সেভাবেই দেখছেন—জান্নাতিরা কীভাবে জান্নাতে সুখলাভ করছেন আর জাহান্নামিরা সেখানে কীরূপ দুর্দশায় আছে। মেরাজের সুখময় বয়ান রেখে দোজকের তিক্ত বর্ণনা দিতে লেখক এখানে দ্বিধাবোধ করছে। তাই সে বর্ণনা আপাতত রেখে সামনে এগোবার প্রয়াস।

জান্নাত-জাহান্নামে ঘোরাঘুরি হলো বেশ। গন্তব্য সিদরাতুল মুনতাহা। এটি একটি বড়ই গাছ। বড়ইগুলো মক্কার উহুদ পাহাড়ের সমান। পাতাগুলো হাতির কানসদৃশ। পাতায় পাতায় পাখিসদৃশ ফেরেশতাদের উড়াউড়ি-ঘোরাঘুরি। আছে সবুজ রঙের আলাদা পাখি। হাদিসের ভাষ্যমতে সেগুলো শহিদদের রুহ। সেখান থেকে উৎপত্তি হয়েছে চারটি নদীর। তার দুটি দুনিয়াতে। অপর দুটি বেহেশতে গিয়ে থেমেছে। ফেরেশতাদের জানামতে এটিই সৃষ্টির শেষসীমা। এরপরে ফেরেশতাদের যাওয়ার অনুমতি নেই। তাই তারা এটাও জানে না—এর পরে কী আছে!

বুরাকের দায়িত্ব এখানে শেষ। দায়িত্ব শেষ জিবরাইলেরও। তিনি আর যেতে পারবেন না৷ এক কদম বাড়বেন তো, সত্তর হাজার নুরের পাখা জ্বলে ছারখার হবে। ই’রাজ শুরু হবে। রফরফ এসে উপস্থিত। রফরফ একটি নুরি গালিচা। কালারটা সবুজ। মাদানি রঙ! আলিফ লায়লার গালিচায় ভেসে বেড়ানোর ধারণা সম্ভবত এখান থেকে। নবিজি সাওয়ার হলেন। রফরফ এগিয়ে চলছে। নুরের জিবরাইল যেতে অপারগ। নবিজি এগোচ্ছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। ওয়াহ! কিয়া বাত! একে একে সত্তর হাজার নুরানি পর্দা অতিক্রম করলেন। একেক পর্দার ঘনত্ব দুনিয়ার পাঁচশো বছরের পথ। একটি মজার তথ্য দিই। এ দীর্ঘ যাত্রায় নবিজি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন। একা সফর কি ভালো লাগে? (মনে রাখবেন নবিজি কিন্তু এখন মালাকি-ফেরেশতার সুরতে) সিদ্দিকে আকবরের রুহকে পাঠানো হলো। তাও মালাকি সুরতে। (সিদ্দিকে আকবর নবিজির চিরসাথী। দুনিয়ায়, কবরে, হাসরে, জান্নাতে এমনকি মেরাজেও) এবার দুজন গল্প করতে করতে এগোলেন।

পৌঁছে গেলেন আরশে। আরশের পাশে লাওহে মাহফুজ। সেখানে কুরআন মহামর্যাদায় সংরক্ষিত।একটি লেখায় নবিজির চোখ আঁটকে যায়—
“আমার রহমত আমার গজবের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে।” সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ!
আরশের প্রতি নবিজির প্রশ্ন: “আমি সমগ্র জাহানের রহমত। তোমার প্রতি সেটা কীরূপ?” আরশের সদর্প উত্তর: সৃষ্টির পর আল্লাহ তাআলা আমার চৌকাঠে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ লিখে দিলেন। আমি থরথর করে কাঁপছিলাম। এই বুঝি টুকরে টুকরো হয়ে যাবো। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তার পাশে লিখে দিলেন, “মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ”। কম্পন থেমে গেল। আমি শান্তি অনুভব করলাম। স্থির হলাম। এরচে’ বড়ো রহমত আর কী হতে পারে!
“আসমানো হি পর সব নবি রাহগেয়ে
আরশে আজম পে পৌঁছা হামারা নবি।”

#পর্ব৩

আরশের সাথে কথাবার্তা শেষ। এবার যাত্রা লা-মকানে। লা-মকান মানে মকানহীন। যেখানে জায়গা বলতে কিছু নেই। স্থান, কাল, পাত্রের ঊর্ধ্বে। নবিজি সবকিছুর উপরে। কত উপরে একবার রিমাইন্ড করা যাক। পৃথিবী থেকেই শুরু করি। চাঁদ, গ্রহ-উপগ্রহ, বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন নক্ষত্র, অগুনতি ছায়াপথ, প্রথম থেকে সপ্তম আসমান। আসমানগুলোর একেকটার দূরত্ব কত? প্রথম থেকে দ্বিতীয় আসমান যতদূর, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় আসমানের দূরত্ব তার ডাবল। এভাবে ক্রমান্বয়ে একটার ডাবল দূরত্বে আরেকটা। এভাবে সপ্ত-আসমান। এরপর বায়তুল মামুর, জান্নাত-জাহান্নাম। জান্নাত-জাহান্নামের বিশালত্ব জানা আছে তো? তারপর সিদরাতুল মুনতাহা। সিদরাতুল মুনতাহার পর আরশে আজিম। এসবের মাঝে আরো কত কী বিদ্যমান সর্বজ্ঞ খোদা আর দেখে আসা নবিই ভালো জানেন। আরশে আজিমের পর লা-মকান। নবিজি এখন সেখানে। সবকিছুর উপরে। সমগ্র সৃষ্টিজগৎ ছাপিয়ে। ঐ লাইনগুলো আরেকবার মনে করি—
“বল,
মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর।”

আলা হযরত আরেকভাবে বলেছেন—
“তুরে মুসা, চরখে ইসা, কিয়া মসা-ভি দানা হো
সব জেহেতকে দায়েরে মে, শশ জেহেত সু তুম ওয়ারা হো”
মুসা কালিমুল্লাহর মিরাজ তুর পাহাড়ে, (কেবল কথার মাধ্যমে।) ইসা পৌঁছেছে আসমান তক। এভাবে সমস্ত নবি-রসুল। তাদের বিশেষ বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাদের সমহিমায় ভাস্বর করেছেন। তবে সবার জন্য নির্দিষ্ট বাউন্ডারি আছে৷ সবার মর্যাদার সীমা আছে। কিন্তু হে হাবিব, আপনি বাউন্ডারি মুক্ত। আপনার জন্য কোনো সীমা নেই৷ কেন কেন? কিঁউ কি—
“সব মঁকা মে, তুম লা-মঁকা মে, তন হে তুম জানে সাফা হো।”
—সবাই স্থানে সীমাবদ্ধ, আপনি সীমানা ছাড়িয়ে। অসীম লা-মকানে। সবাই যেখানে দেহে আচ্ছাদিত, আপনি সেখানে নবরূপে হাকিকি সুরতে অধিষ্ঠিত। ”

লা-মকানের সবটা খোদায়ী নুরে আচ্ছাদিত। নবিজি হাকিকি সুরতে। সে সুরত কীরূপ? আল্লাহই ভালো জানেন। নবিজিই ভালো জানেন। নবিজি পৌঁছে গেলেন আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকেও নিকটে। সে নৈকট্য কীরূপ। “ক্বাবা ক্বাওসাইনি আও আদনা।” তীর আর ধনুকের দূরত্ব। নয়, তারচেয়েও অধিক। প্রশ্ন করি—তীর আর ধনুকে কি দূরত্ব থাকে? নারে পাগলা। একটার সাথ আরেকটা লাগানো থাকে, লাগানো। নবিজি মূলত খোদার নুরে বিলিন হয়ে গেছেন। খোদার খোদায়িত্বে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। ফানা-ফিল-হক, ফানা-ফিল্লাহ!
“খোদাকে আজমত কিয়া হ্যায়? মুহাম্মদ মুস্তফা জানে
মকামে মুস্তফা কিয়া হ্যায়? মুহাম্মদকা খোদা জানে।”
কসম খোদার! আমরা জানি না। সে মকাম কোথায়, কীরূপ—আমাদের অজানা। সে জট হাসরেই খুলবে। যখন তিনি মকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত হবেন।

বন্ধু বন্ধুর দাওয়াতে গেলে হাদিয়া নেন। আল্লাহর দাওয়াতে নবিজি আল্লাহর সান্নিধ্যে। নবিজি কী নিয়ে গেলেন? চির-পবিত্র চির-সুন্দর জবানের চির-সত্যকণ্ঠের চির-মোহনীয় সুর—
“আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস সালাওয়াতু ওয়াতত্বয়্যিবাত—না জবান, না অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, না ধন সম্পদ, বরং যা যা আছে—সবটা আপনার প্রশংসায় উপহার সরূপ পেশ করলাম। বাহ! কত দারুণ উপহার! কত উত্তম উপহার! কত দিলখুশ উপহার! কুরআনের প্রথম শব্দযুগলও ঐ কথাই বলে—“আলহামদুলিল্লাহ-সমগ্র প্রশংসা আল্লাহরই!

উপহার পেয়ে খোদ খোদা তৃপ্ত। তিনি তৃপ্ত! স্রষ্টা তৃপ্ত! ভাবা যায়? কল্পনায় আসে? উপহার পেয়ে রিয়াকশন কী এলো? আল্লাহ কী বললেন?
“আস্সালামু আলাইকা আইয়ুহান নাবিয়্যু ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু—ওহে প্রেমময় নবি, আপনার প্রতি সালাম, আপনার প্রতি রহমত, আপনার প্রতি বরকত!” এ প্রকাশকে কী বলবো? কত সুন্দর! কত মোহনীয়! এভাবে? নাহ, সবচে’ সুন্দর, সর্বোৎকৃষ্ট, সবচে মোহনীয়! আল্লাহু আকবর! লা-মকানের সে আওয়াজ সেদিন সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছে গিয়েছিল। ফেরেশতারা এ অভূতপূর্ব সংলাপ শোনে সমস্বরে সাক্ষ্য দিলো—
“আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া  রাসুলুহু।” সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পবিত্র!

এবার নবিজির চাওয়ার পালা। নবিজি চায়বেন। সরাসরি নেবেন। দেবেন আল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা জানতে চান—আপনি কী চান?
—ওগো আল্লাহ, রাব্বুল আলামিন! আমাকে বানিয়েছেন “রাহমাতুল-লিল-আলামিন”। কী চাইতে পারি? গোনাহগার উম্মত রেখে এসেছি দুনিয়ায়। আমার উসিলায় তাদের ক্ষমা করে দিন।
—নিজের উসিলা দিয়েছেন। না-করি কী করে? ৭০ হাজার ক্ষমা করলাম। আর কী চান?
নবিজি আর কী চায়বেন? দুনিয়ার সুখ? আসতাগফিরুল্লাহ! বেহেশতের বাদশাহী? সেটা তো অলরেডি পেয়ে বসে আছেন? ইতোমধ্যেই তিনি সমগ্র জাহানের রহমত! আর কী চায়বেন? একই জিনিস বারবার চাইলে ক্ষতি কী? দেনে ওয়ালা তো উপবিষ্ট। উম্মতের তো অভাব নাই। ৭০ হাজারে কী হবে? একই চাওয়া আবারও।
—উম্মতদের ক্ষমা করে দিন।
—আচ্ছা আরো ৭০ হাজার দিলাম। আর কী চান?
—উম্মতদের ক্ষমা করে দিন!
আল্লাহ তায়ালা ৭০ হাজার করে দিয়ে যাচ্ছেন, নবিজি চেয়ে চলেছেন৷ এভাবে ৭০০ বার চায়লেন। আল্লাহ তায়ালা ৭০০ বার-ই দোয়া মঞ্জুর করলেন। ৭০১ বারে গিয়ে নবিজিকে থামালেন। এবার থামুন। আর চাইয়েন না। এখানে সব দিয়ে দিলে হাসরটা কার শান দেখাতে সাজাবো? বাকিটা হাসর-মাঠে দেয়া হবে। ফেরেশতা, আম্বিয়া, আউলিয়াসহ পুরো হাসরবাসীদের সামনে। আপনি চাইতে থাকবেন, আমি দিতে থাকবো। এত এত এত দেব যে, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিক।

এভাবে সংলাপ চলতে থাকে। কত কালাম হয়েছিল? কী কী কথা হয়েছিল? কুরআন কী বলে?
“ফা-আওহা ইলা আবদিহি মা আওহা—যা গোপনে বলার প্রিয়তমকে তা গোপনে জানিয়ে দিলেন।”
কাসাসুল আম্বিয়ার ভাষ্যমতে কালামের সংখ্যা ৯০ হাজার। ৩০ হাজার আমরা জেনেছি হাদিসের মাধ্যমে। আর ৩০ হাজার তাঁর আয়ত্তাধীন। যাঁকে যাঁকে ইচ্ছা—জানিয়েছেন। নবিজির ইন্তেকাল-পরবর্তী সাহাবি, তাবেয়ি, গাউছ, কুতুব, আবদাল, আওলিয়াদের অনেক কাজ, কথা কুরআন হাদিসে পাওয়া যায় না। মিলে না। আমরা দ্বন্দ্বে পড়ি। এসব দ্বন্দ্ব বোধয় এখানে শেষ হলো। ঐ ত্রিশ হাজার কথা নবিজি খাশমহলে বিতরণ করেছেন। সেখানে থেকে কিছু কিছু প্রকাশ হয়ে গেছে। এজন্যে তাঁরা যা বলে গেছেন, তা মনগড়া বা খামখেয়ালি বলা ধৃষ্টতা। চরম ধৃষ্টতা। সাবধান হোন! আল্লাহর অলিদের ব্যাপারে সাবধান হোন! তাদের কথা-কাজ বুঝে না-আসলে চুপ থাকুন। এটা আপনার জ্ঞানের দুর্বলতা। বোধশক্তির সীমাবদ্ধতা। আপনি দুর্বল। প্রচুর দুর্বল। খুব কম জানা লোক। সবজান্তার মতো বিহিভ বন্ধ করুন।

৬০ হাজারের হিসাব শেষ। বাকি ৩০ হাজার। এসব অপ্রকাশিত। রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে রাহমাতুল-লিল-আলামিনের উপর আমানত। হাদিসে পাকের অমীয় সুধা জানান দেয়—
“ওমিরতু বিকিতমা-নিন বা’দ্বিহা—অনেকগুলো বিষয় গোপন রাখার বন্দোবস্ত হয়েছে।” আল্লাহ এবং রাসুল ছাড়া তৃতীয় কেউ জানে না। আশেক-মাশুকের মহা আয়োজন সমাপ্তির পালা। এবার ফেরার পালা। ইন্নাল্লাহ ওয়া মালা-ইকাতাহু ইয়ুসাল্লু-না আলান নাবি...

আরেকটু বাকি। ফেরার পথে ফিরে ফিরে চাওয়ার গল্প। নুরানি চোখের নুরপ্রীতির দৃশ্য। কথার ভেতরের কিছু কথা। গল্পের ভেতরের গল্প৷ আসছে...

#পর্ব৪

মেরাজ-রাজ ফেরার পথে। আসতে আসতে ষষ্ঠ আসমান। মুসা আলাইহিস সালামের সাথে ফের সাক্ষাৎ। নবি মুসা চমকিত! ও, আপনি এসে গেছেন? বহু কথা হয়েছে নিশ্চয়? স্পেশাল উপহার পেয়েছেন অনেক। আপনি তো উম্মত-পাগলা। তাদের জন্য কী আনলেন? রব-তায়ালা কী দিলেন?
—পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ৷
—পঞ্চাশ ওয়াকতঅঅঅঅ!?

তুর পাহাড়ে একবার বেহুশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। খোদার নুরের ঝলক সহ্য করতে না-পেরে। আবার যেন পড়ে পড়ে অবস্থা! পারবে না, পারবে না। এ বড় কঠিন হয়ে যাবে। আপনি আবার যান। কিছু মওকুফ হয় কি-না দেখুন। মুসা নবির কথায় যুক্তি আছে৷ পাঁচ ওয়াক্তে যা অবস্থা, পঞ্চাশ ওয়াক্ত হলে...!

যাইহোক, নবিজি আবার গেলেন। কোথায়? ঐ যে, লা-মকান। খোদার সান্নিধ্যে। ইয়া রাব্বি, বেশি হয়ে গেছে। উম্মতের কষ্ট হবে, পেরে উঠবে না। কমিয়ে দিন।
—আপনি মাহবুব! কথা ফেলা যায়? পাঁচ ওয়াক্ত কমালাম।

নবিজি ফের ষষ্ঠ আসমানে। মুসা নবির প্রশ্ন: ঘটনা কী বলুন। বন্দোবস্ত কী হলো?
—পাঁচ ওয়াক্ত কমেছে।
—মাত্র পাঁচ ওয়াক্তঅঅ? হবে না, হবে না। আপনার উম্মতেরা পারবে না। আবার যান।

নবিজি আবার হাজির। ইয়া রাব্বি, অন্যান্য নবির উম্মত এক, দুই ওয়াক্ত ঠিকঠাক পড়ে নাই। আমার উম্মত শেষ জামানার। আকৃতি ছোট। গড়নে দুর্বল। অত পারবে না। আরো কমিয়ে দিন।
—ঠিক আছে৷ আরো পাঁচ ওয়াক্ত মাফ।

আবার ষষ্ঠ আসমান। মুসা নবির আবদারের শেষ নাই। আবার যান! এই ‘আবার যান’টা মোট নয়বার চললো। পাঁচ ওয়াক্ত করে কমতে কমতে মোটে পাঁচ ওয়াক্ত থাকলো। সাথে আল্লাহর ঘোষণা এলো। পাঁচ ওয়াক্তের ঠিকঠাক পড়লে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সাওয়াব দিয়ে দেয়া হবে। আজীবন মেয়াদের দারুণ প্যাকেজ—“একে দশ, পাঁচ দশে পঞ্চাশ!”

একটা প্রশ্ন করি? ষষ্ঠ আসমান থেকে নবিজি কতবার লা-মকান ফেরত গেলেন? এক, দুই, তিন, চার... নয়। হ্যাঁ, নয় বার। এবার আমাকে হিসাব দিন—ঐ রাতে মাওলার দিদারে নবিজি কতবার গেলেন? মাওলার সাথে সর্বমোট কতবার দিদার হলো? ঐ সফরে মেরাজ কতবার হলো?

এবার আল্লাহকে একটা প্রশ্ন করি। কাল্পনিক প্রশ্ন আর কী। ওহে মাওলা, পাক পরওয়ারদিগার! আপনি চাইলে একবারে পয়তাল্লিশ রাকাত কমাতে পারতেন। কিংবা প্রথমেই পাঁচ রাকাত দিতে পারতেন। নবি মুস্তফা যে আবার ফেরত যাবেন, নবি মুসা যে বারবার পাঠাবেন—সে তো আপনার অজানা নয়। আপনি যে আলিমুল গায়ব। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবটা সমানভাবে জানেন। তো, এই আজব খেলা কেন? এর রহস্য কী? কেন বারবার তাঁকে আসা-যাওয়ার মধ্যে রাখলেন?

—আহা! প্রিয়তমের ফিরে ফিরে তাকানোর মর্ম কে বুঝে? যাওয়ার পথে বারবার এসে আলিঙ্গনের স্বাদ কে জানে? কেউ বুঝে না। কেউ-ই জানে না। কেউ নারে পাগলা, কেউ না। ঐ দুজনই বুঝে। প্রিয়তম আর প্রেমাস্পদই জানে এর মজা কী? এর হাকিকত কী? বাকিরা বুঝে না। অত গভীরে তাদের চোখ যায় না। মেকি ভাবে, মেকি। থাক, কথা বাড়িয়ে লাভ নাই৷ এও সে প্রেমের খেলা। কজনেই বা মর্ম বুঝে? কজনেই বা ধরতে জানে?

প্রশ্ন এবার মুসা নবির কাছে। ওগো কালিমুল্লাহ! আপনার কী দরকার ছিল? আখেরি নবির উম্মতের কষ্টে আপনার কী আসে যায়? নবিকে এভাবে বারবার পাঠিয়ে আমাদের কষ্ট লাগব করে আপনার লাভটা কী?

—আছেরে পাগলা। লাভ আছে। ছোটখাটো লাভ না। বিশাল লাভ। সেটা কেমন? ঐ যে, তুর পাহাড়। খোদার নুরে জ্বলে সুরমায় রূপান্তর। ওটাতে উঠে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম। “রাব্বি আরিনি—প্রভু দেখা দাও।” প্রভুর জবাব আসতো—“লান তারানি—দেখা সম্ভব না।” এভাবে বহুকাল চলছে। বহু কেঁদেছি। একদিন ফরিয়াদ কবুল হলো। খোদার সত্তর হাজার নুরারি পর্দার ভেতর থেকে একটুখানে ঝলকানি আমার উপর পড়েছিল। বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম। উঠে দেখি উহুদ জ্বলে সুরমা হয়ে গেছে। বিশেষ কৃপায় দেহ টিকে গেছে। দেখার সৌভাগ্য আর হয়নি। দেখার আগেই বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলাম।

তাতে কী? ওটা তো পুরান গল্প। এটার সাথে সম্পর্ক কী? আছে আছে, বলছি। সেই যে নুরের ঝলক। দুনিয়া থেকে দেখিনাই। কিন্তু আজ? আজ দেখে ফেলেছিরে পাগলা, দেখে ফেলেছি। রহমাতুল্লিল আলামিন যখন খোদার দরবার থেকে এসেছে, তার সর্বাঙ্গে খোদার নুরের চমক খেলা করছিল। তোরা দেখিসনি, কীভাবে সূর্যের আলোয় চন্দ্র আলোকিত হয়ে চন্দ্র থেকে স্নিগ্ধ আলো ছড়ায়? ঠিক ঐরকমরে পাগলা, ঐরকম। আমার ওহুদের ব্যথা আজ উপশমিত। কেননা আমি নবি মুস্তফার মাধ্যমে খোদার তাজাল্লি দেখে ফেলেছি। তাই সুযোগ মিস করিনি। যতবার সম্ভব হয়েছে। তাঁকে খোদার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। নবি মুস্তফা খোদার দিদারে ধন্য। আমিও তাঁর মাধ্যমে খোদার নুরি ঝলকে ধন্য।

মসনবি খুলুন। মাওলানা রুমি কী বলেছেন? “নবি-মুস্তফা খোদা দেখার আয়না-স্বরূপ!” সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! আলা হযরতের কালাম শুনি—
“কিছ কো দেখা ইয়া মুসা ছে পুঁচে কুয়ি,
আঁখ ওয়ালো কি হিম্মত পে লাখো সালাম।”
সেদিন মুসা আলাইহিস সালাম কাকে দেখেছিলেন, কেউ তাঁকে তা জিজ্ঞেস করো। দিব্যদৃষ্টি-সম্পন্ন সত্তার প্রতি লক্ষ সালাম।

গল্পের ভেতরের গল্প থেকে গেল। কথা দেখি বেড়ে চলেছে। আরো কিছুদিন লেগে যাবে। আরো দুয়েক পর্বের অপেক্ষা। আজ এটুক।

#পর্ব৫

বলছিলাম গল্পের ভেতরে কিছু গল্প বাকি। এবার সেগুলোর দিকে নজর দেই৷ সিদরাতুল মুনতাহা ছেড়ে নবিজি এগিয়ে চলছেন। অথচ জিবরাইল দাঁড়িয়ে। আর যেতে পারছেন না। আগালেই বিপদ। স্বয়ং জিবরাইলেল ভাষ্য, “আরেকটু আগালেই সত্তর হাজার নুরের পাকা জ্বলে যাবে”। তাহলে নবিজি কীভাবে যাচ্ছেন?

জিবরাইল ফেরেশতা-সরদার। নুরের সৃষ্টি। ডাউট নেই তো? না, নেই। এ নিয়ে তর্কে যেতে কাউকে দেখিনি। নুরের জিবরাইল যেতে অপারগ, নবি আগাচ্ছেন স্বাচ্ছন্দ্যে। নবি তো সাধারণ মানুষ। আমাদের মতো৷ তাই না? নবি নিজেই বলেছেন, “আনা বাশারুম মিছলুকুম—আমি তোমাদের মতোই বাশার।” আরে হ্যাঁ, আমাদের মতোই তো! কুরআনে আছে! স্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত৷

বলি কী, ওহে নবির মতোরা! কই আপনারা? আপনাদের একটু খুঁজতেছিলাম। এগিয়ে আসবেন কেউ? বেশি কিছু না। একটু উড়ে উড়ে গাছে উঠে দেখান তো! আরশ, ফরশ, সিদরা, আসমান না। গাছ অবদি উঠলেই হবে। উড়তে না-পারলে আল্লারে একটু কন। একটা বুরাক পাঠাতে। ঐটাতে কইরা যদি একটু উইড়া দেখাইতেন।

আহাম্মকের দল। ‘বাশারুম মিছলুকুম’ দেখলা, ‘রাহমাতাল্লিল আলামিন’ দেখলা না? মেষ চড়াইতে দেখলা, মেরাজ-রাতে লা-মকানের সফর দেখলা না? বিয়ে-শাদি করছে, বাচ্চাকাচ্চা জনম দিছে—এইটুক দেখলা, জাবেরের মৃত পুত্ররে জীবিত করতে দেখলা না। মানবীয় সুরত তো দেখলা, লা-মকানের হাকিকি নুরের খবর পাইলা না? বদবখত, আন্ধা কোথাকার!

এবার আসুন, হাকিকত জানি। ইয়া রাসুলাল্লাহ, কীভাবে গেলেন? জিবরাইলও নুর আপনিও নুর। দুজনেই নুর। আপনি যেতে পারেন, জিবরাইল পারে না কেন? আরে গাধা, জিবরাইল তো নুর, আর আমি সরকারে দু’আলম তো নুরুন আলা নুর!

নুরুন আলা নুর মানে? নুরের নুর। নুরের বাপ নুর। বুঝেন নাই। বাপের বাপ বুঝেন? দাদা বলি আমরা। ‘বাপের বাপ’ কথাটাকে ধরে একটু ধারাবাহিক আগান তো। এভাবে- বাপের বাপ, তার বাপের বাপ, তার বাপের বাপ। যেতে থাকেন। আরো যান। কতটুক গেলেন? হ্যাঁ, আদম আলাইহিস সালাম পর্যন্ত। তারপরে আর নাই। তিনি “আদি পিতা”। সব বাপের বাপ। প্রথম মানব।

বাপ ছাড়েন। এবার নুর ধরেন। নুরের নুর, নুরের নুর, নুরের নুর, নুরের নুর। বাদ দেন। লম্বা লাইন। গুনে শেষ করতে পারবেন না। একটা লাফ দেই। আদি নুরে চলে যাই। আদি পিতার স্টাইলে। কিন্তু কোথায় যাই? আদি নুর কোনটা? সহজ সূত্র। নবিজি কী বলেছেন? “আউওয়ালা মা খালাকাল্লাহু নুরী— আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমি নবির নুরকেই সৃষ্টি করেছেন।” হ্যাঁ, নবিজিই আদি নুর। মূল সৃষ্টি। বাকিরা মূল না। মৌলিক না। হিস্যাপ্রাপ্ত। নুরের অংশ পেয়েছে কেবল। কী, বিশ্বাস হয় না।?

চলুন, জিবরাইলকেই জিজ্ঞেস করি। দাঁড়ান, নতুন করে জিজ্ঞেস করার দরকার নাই। নবিজি জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেটা কেমন দেখি। “হে জিবরাইল! আপনার বয়স কত? ইয়া রাসুলাল্লাহ! বয়স তো ঠিক জানি না। তবে জন্মের পর থেকে আমি একটা তারার সাথে পরিচিত। সেটি ৭০ হাজার বছর পরপর উদিত হত। এই তারাটি আমি ৭২ হাজার বার দেখেছি। “হে জিবরাইল, তুমি কি জানো, তারাটি কে? ওটা স্বয়ং আমিই।” জিবরাইল ৭০ হাজার বছর পরপর দেখতে দেখতে বাহাত্তর হাজার বার দেখে ফেলেছে। এত বছর পরপর দেখেছে। এত হাজার বার দেখেছে। তারমানে কী? তারার বয়স কী ঐটুকুই? আরে না, জিবরাইল জন্মের পর থেকে দেখেছে। মানে ওটা এর আগেও ছিল। কত আগে থেকে ছিল খোদা মালুম। সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ!

কী বোঝা গেল? নবিজি আদি সৃষ্টি। আদি নুর। মানে সব নুরের নুর। আই রিপিট, হাকিকত নুর। মৌলিক নুর। তাই নুরের জিবরাইল সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করতে না-পারলেও নুরের নবি পারেন। আগান স্বাচ্ছন্দ্যে। নিজ চোখেই দেখে আসেন আল্লাহর তাজাল্লী।

নুরের আলোচনা আরো ব্যাপক। পড়ার মতো অত ধৈর্য আপনাদের নেই। এতটুকুতেই রাখি। তবে বলে রাখি, হাকিকতে ঐ নুর কেমন শুধুমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। আগেই বলেছিলাম, “মকামে মুস্তফা কিয়া হ্যায়, মুহাম্মদ কা খোদা জানে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!

আরেকটু বাকি। আরো দুয়েকটি কথা। আসবে...

#পর্ব৬

মেরাজ শেষ। নবিজি ফিরে এলেন। বিছানা এখনো গরম। অথচ  আসমানের ওপারে কেটে গেছে ২৭ বছর! বিধাতার লীলা। সময় কোথাও থমকে দাঁড়ায়, কোথাও চলে অবিরাম। নাকি এ সাতাশ বছর পুরো পৃথিবী ঘুমে ছিল কে জানে! পৃথিবীর প্রাণ লা-মকানে, পৃথিবী জাগবে কোন কারণে—এও এক কথা।

নবিজি যতক্ষণ আসেননি, পাখিরাও আর ডাকেনি। ঝরনার কলকল শোনা যায়নি। নদীর জোয়ার-ভাটা অবসরে। ঢেউ মেরে গর্জেনি সমুদ্র। চন্দ্র-সূর্য ঘুরেছিল কি নবির ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিল কে জানে! কেউ যে জাগেনি। আসহাবে কাহাফ আর ওযাইর আলাইহিস সালামের ঘটনা তো অনেক সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

রাত শেষে ভোর হলো। নবিজি মেরাজের বয়ান দিলেন। কাল এই এই ঘটনা ঘটেছে। কাফিররা বিদ্রুপ করতে লাগলো। কথার জালে বন্দী করতে ফন্দি আঁটা শুরু আর কী। নবুয়ত প্রকাশের পর থেকে নিত্যাকার অভ্যাস। ছাড়া তো যায় না। ভাবনায় বিভোর—কীভাবে আঁটকে দেয়া যায়? শান-মান ক্ষুণ্ন করা যায়।

উপায় একটা পেল। মক্কার মাথারা(আবু জাহেল ও তার সাঙ্গপাঙ্গ) বায়তুল মোকাদ্দাস চেনে। নবিজি এর আগে ওখানে যাননি—সেটাও জানে। ওটা দিয়ে প্রশ্ন করলে আঁটকানো যাবে। প্রশ্ন শুরু—মোকাদ্দাসে দরজা কটা? জানালা কটা? দেখতে কীরূপ? এবার বলুন—সফর তো আপনারাও করেন। করেন তো? গিয়ে নামাজও পড়েন মাঝেমধ্যে। বলুন দেখি, কোন মসজিদের কটি দরজা? জানালা কটি? রং করা না নাকি টাইলস করা? এসব হিসাব রাখেন? গুনেন? এসব গোনার জিনিস? হিসাব রাখার বিষয়? আবু জাহেল বলদ না? প্রশ্নগুলো বলদা টাইপ না? মেরাজ সশরীরে না স্বপ্নযোগে—এ প্রশ্নটাও বলদা টাইপ। প্রশ্নকারীরাও বলদ। কীভাবে? দাঁড়ান, বলছি।

তারা বলে, নবিজি যাননি, স্বপ্নে দেখেছেন। আরশমুআল্লাহ যাননি। লা-মকান যাননি। সপ্ত-আসমান বা জান্নাত-জাহান্নাম, কোত্থাও ভ্রমণ করেননি। কেন বলে? সশরীরে গেলে শান বাড়ে। নবিজি অত শান ওয়ালা না! একটু কমানো যদি যায়! একটু খাটো যদি করা যায়!

প্রশ্ন জাগে, কমাতে চাইলেও কি কমানো যায়? দেখা যাক৷ ধরে নিলাম নবিজি যাননি। এর মানে কী? হাদিস কী বলছে? “নবিদের স্বপ্ন সত্য।” নবিজির স্বপ্ন সত্য৷ সোজা হিসাব—নবিজি স্বপ্নে যা যা দেখেছেন, তা তা ঘটেছে৷ ভেজাল ভেজাল লাগছে? কেমন যেন প্যাঁচানো কথা। চলুন, জট খুলে দেই। আবু জাহেলদের প্রশ্নের মুখে কী ঘটলো দেখি।

নবিজির শান দেখুন। জাহেলদের উদ্ভট প্রশ্ন খোদার কুদরতি কানে পৌঁছে গেল। খোদা তায়ালা এসিস্ট্যান্ট পাঠালেন৷ এসিস্ট্যান্ট হলো ফেরেশতা। খোদার হুকুম—যাও, বায়তুল মোকাদ্দাসকে আমার হাবিবের সামনে বসিয়ে দাও৷ মনে করে করে উত্তর দেয়া বড় ঝামেলার ব্যাপার। হাবিবকে এত কষ্ট দিতে পারবো না। মেরাজি-দোলহার এত কষ্ট মানায়সই না।

একটু নজর দেবেন? জী, বায়তুল মোকাদ্দাসকে নবিজির সামনে আনার বিষয়টাতে। লক্ষ্য করুন! আবার বলছি, লক্ষ্য করুন! নবিজি কিন্তু মনে করে করে উত্তর দেননি। হাজের-নাজেরের পাওয়ার কাজে লাগিয়ে জেরুজালেমের আকসায়ও যাননি। বরং জেরুজালেমের আকসা নবিজির সামনে এসে গিয়েছিল। হ্যা হ্যা, জেরুজালেমের আকসা নবিজির সামনে এসে গিয়েছিল।

এবার পুরান কথাই ফিরে যাই৷ বলা হয় নবিজি মেরাজ যাননি। আরশে যাননি। লা-মকানে যাননি। আল্লাহর শাহী দরবারে যাননি। এর মানে কী? বলুন, এর মানে কী? আরশ নবিজির দরবারে এসে গিয়েছিল। মকানহীন “লা-মকান নবিজির খেদমতে হাজির হয়েছে। সমস্ত নবি-রাসুল, সপ্ত-আসমান, জান্নাত-জাহান্নাম, আরশ-কুরশি, লৌহ-কলম, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র যা যা আছে, সব নবিজির কদমে হাজিরা দিয়েছে। নয়, এটুকু নয়। স্বয়ং খোদ খোদা তাঁর শাহী দরবার-সহ নবিজির কাছে এসে নবিজিকে দেখা দিয়েছেন। আরেকবার পড়ুন, আল্লাহু আকবার! আল্লাহ মহান। যা চান, তাই করেন।

এবার বলুন, ‘স্বপ্নে’ বলাতে শান বাড়লো না কমলো? আমি জাজ করতে পারছি না। আপনারাই বলুন। বেকুবের দল কমাতে চেয়েছে; অথচ... ওরে ও বেকুব, কুরআনের ঐ আয়াত তো দেখ। আমার আল্লাহ কী বলেছেন? সুরা ইনশিরাহ খোল। “ওয়ারাফা'-না লাকা জিকরক।” মাহবুব, আমি আপনার শানকে সমুন্নত করেছি। সর্বোচ্চ মকামে তুলেছি। হ্যা, আমার আল্লাহ রফা করেছেন। তোমার চাইলেও দফা করতে পারবে না। পারবে না বলছি। খোদার কসম পারবে না। কিঁউ কি ইয়ে মুশকিল নেহি, না-মুমকিন হ্যায়।

পর্ব-৭
(শেষ পর্ব)

শুক্কুর মিয়া ঘুম থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো। বন্ধুদের কাছে গিয়ে বেশ জোসের সাথে গর্ব করতে করতে বললো—রাতে দুবাই থেকে ঘুরে এলাম। বন্ধুরা উৎসুখ। কী করে, কী করে? শুক্কুর মিয়া একগাল হেসে উত্তর দিল—স্বপ্নে দেখছি। বন্ধু গফুর মিয়া ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বললে—শালার পুত, আমি তো স্বপ্নে গতকাল অ্যামেরিকা থেকে ঘুরে আসছি। এই শোনে বক্কর মিয়া হাসতে হাসতে বললো, তোরা রাখ। আমি গতকাল সোজা আসমানে গিয়ে চারটা ফুটা করে এলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি কাঁথায় চারটা ফুটো হয়ে গেছে। এই শোনে তিনজনে মিলে হেসে হেসে অনেক্ষণ গড়াগড়ি দিলো।

মেরাজ বাস্তবে না স্বপ্নে? সশরীরে না রুহানিভাবে? একটা দিক ক্লিয়ার। যেটাই হোক, সমস্যা নেই। নবিজির শান ঊর্ধ্বমুখী। কেউ চায়লে নিচে নামাতে পারবে না।

কিন্তু বিষয়টা ক্লিয়ার হওয়া দরকার। স্বপ্নে না বাস্তবে? এ প্রশ্নের জবাব আবু জাহেলদের প্রশ্নে লুকায়িত। উপরের গল্প কী প্রমাণ করে। স্বপ্নে যে কোনো কিছুই ঘটতে পারে। যে কোনো কিছুই দেখা সম্ভব। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। কিন্তু আবু জাহেলরা প্রশ্ন তুলেছিল। কী বুঝা গেল? নবিজি স্বপ্ন নয়, বাস্তবের বর্ণনা দিয়েছেন। বাস্তব বলে দাবি করেছেন বলেই তারা প্রশ্ন তুলেছিল।

আরো কিছু ব্যাপার— স্বপ্নে হলে বোরাক, রফরফ কোনোটার দরকার নাই। স্বয়ং জিবরাইল আসারও কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই। ওহির সাত প্রকারের একটা ‘স্বপ্নযোগে’। যখন জিবরাইল আসে না। ওহি সোজা নবিজির স্বপ্নে এসে যায়। এ-ছাড়াও ‘তাফসিরে রুহুল বয়ান’ খুলুন। সেখানে কী লেখা আছে? স্বপ্নযোগে নবিজির মেরাজ ৩৩ বার হয়েছিল! একবার সশরীরে। বাস্তবে, জাগ্রত অবস্থায়। সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ!

কুরআন এটির প্রমাণই দিচ্ছে—
“সুবহানাল্লাজি আসরা বিআবদিহি” বলে। আবদুন। সোজা অর্থে বান্দা। আবদিহি—তাঁর বান্দা। এ বান্দা কেমন, খোদার কত প্রিয়—তা আমরা মেরাজের গল্প থেকে বুঝেছি। আবদুল খালেক, আবদুল মালেকের মতো সাধারণ বান্দা ভাবার ধান্দা করে লাভ নেই। এবার আসি ‘আবদ’ কাকে বলে? সর্বসম্মতিক্রমে রুহ আর দেহের সমষ্টির নাম বান্দা। শুধু রুহ অথবা শুধু দেহকে বান্দা বলার চান্স নাই। স্বপ্নে হলে রুহের প্রশ্ন আসে। দেহের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু আল্লাহ সুবহান বলে নিজের পবিত্রতা ঘোষণা দিয়ে কী বলেছেন? আবদিহি—তাঁর প্রিয় বান্দা। হ্যাঁ, তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে নিয়ে গেছেন। রুহকে না। বান্দা হলো রুহ আর দেহের সমষ্টি। এজন্যই বলি, নবিজি সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় গেছেন।

এসব তর্ক বেহুদা। প্রেমিকরা প্রশ্নের ধার ধারে না। বিনা প্রশ্নে বিনা তর্কে সত্য বলে মেনে নেয়। আর যে মেনে নেয়, সে ‘সিদ্দিক’ হয়। না মানলে ‘জাহেল-মূর্খ’ হয়। তবু জাহেলদের জাহেলি থেকে আমজনতাকে বাঁচাতে কাঁঠাল জনতাদের সত্যটা ক্লিয়ার করতে হয়। মনে হয় আপাতত ক্লিয়ার। চলুন, এরপরে যাওয়া যাক—

বায়তুল মোকাদ্দাস নিয়ে প্রশ্ন শেষ। কিন্তু এক থাপ্পড়ে আবু জাহেলে গালের বিষ মরে না। তার চায় মহিষের পদাঘাত। সে আবার প্রশ্ন করে—“গতকার আপনি যে রাস্তা দিয়ে আকসায় গেছেন, সে রাস্তায় আমাদের এক কাফেলা থাকার কথা৷ তাদের দেখেছেন? নবিজি বলে দিলেন, “তারা আগামীকাল সূর্য উঠার আগেই এসে পৌঁছুবে।”

নবিজির কথার হেরফের হয়নি। ঠিক ঐ সময়েই তারা পৌঁছেছিল। এটাকেই বলে ‘এলমে গায়েব’। অদৃশ্যের জ্ঞান। আমজনতা যা দেখে না, তা বলে দিতে পারা, তা দেখতে পারা। নবিজি জীবদ্দশায় এমন হাজারো গায়েবের খবর দিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে—এসব নবিজিকে দেখানো হয়েছিল। তিনি দেখে ফেলেছিলেন। দেখেই যখন ফেলেছিল, তা আর গায়েব রইল কই? যা দেখেছেন, তাই বর্ণনা দিয়েছেন—গায়েব রইল কই?

বলি কি—আল্লাহর কাছে কোন বিষয়টি অদৃশ্য? কোন জিনিসটা এমন আছে—যা তিনি দেখেন না? হ্যাঁ, তিনি সবটা দেখেন। সব তাঁর দৃষ্টিশক্তির সামনে। নখদর্পনে। তবু তিনি ‘আলিমুল গায়ব’! সব আল্লাহর সামনে হওয়ার পরেও গর্ব করে আল্লাহকে “আলিমুল গায়েব” বলে ডাক মারে। অপর দিকে নবিজির বেলায় যুক্তি মারে—তাঁকে তো দেখানো হয়েছে! আল্লাহ সবকিছু দেখেও আলিমুল গায়ব, নবিজি দেখলে গায়েব না! অদ্ভুত জীব! অদ্ভুত যুক্তির ধারা এদের।

তো, নবিজি এলমে গায়েব জানেন—ক্লিয়ার হলে। কিন্তু কতটুক? কদ্দুর জানেন?

তার আগে বলুন, সবচেয়ে বড় গায়েবটা কী? স্রষ্টা। আল্লাহ। আমরা যত গায়েবে বিশ্বাসী, তার সবটা আল্লাহর কারণেই। প্রথম বিশ্বাসটা আল্লাহর উপর। “আ-মানতু বিল্লাহি।” আমি ইমান আনলাম আল্লাহর ওপর। বাকিগুলো তারপর? আল্লাহর উপর বিশ্বাসী না-হলে বাকি সব বিশ্বাসের কোনো মূল্য নেই।

এবার বলুন, “আল্লাহ এক”—এ তত্ত্ব আমরা কেথায় পেলাম? কে জানালো এ খবর? আল্লাহ এসে নিশ্চয় বলে যাননি। হ্যাঁ, এ খবর আমাদের দিয়েছেন নবি মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এভাবে আদম থেকে শুরু করে যত নবি-রাসুল এসেছেন, সবাই এ সংবাদ প্রচার করেছেন। এ গায়েবের বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে আবেদন জানিয়েছেন।

মজার বিষয় দেখুন। আমার নবির মর্যাদা দেখুন। তাঁর গায়েবের সীমা কোথায় দেখুন—

ওগো আদিপিতা আদম আলাইহিস সালাম। বলছেন তো আল্লাহ এক৷ আপনি কি তাঁকে দেখেছেন? না তো, আমি দেখিনি। জিবরাইল খবর দিয়েছে। আমি শুনেছি। ইয়া শীষ, আপনি দেখেছেন? না তো, শুনেছি। ইয়া ইবরাহীম, আপনি? না না বাবা, দেখিনি, শুনেছি। ইয়া ইসমাইল, হারুন, লূত, ইসা, আপনারা দেখেছেন? নারে বাপু, দেখিনি। তাঁকে দেখা ছাড়াই বিশ্বাস করতে হয়। তোমাদেরও তাই করা উচিৎ। ইয়া মুসা, আপনি দেখেছেন? না, তবে আমার সাথে কথা হয়েছে তুর পাহাড়ে। সে কী কথা, আপনারা সবাই সাক্ষ্য দিচ্ছেন, আল্লাহ এক। অথচ কেউ দেখেননি। না-দেখে সাক্ষী মানা তো রীতিবিরুদ্ধ। কোর্টে গিয়ে শুনেছি বলে সাক্ষ্য দিলে তো হাকিম সাহেব পিঠের আস্ত রাখবে না। মানি কী করে?

আচ্ছা, আরেকটু আগাই। শেষনবি বাকি। নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। ইয়া রাসুলাল্লাহ, ইয়া হাবিবাল্লাহ, আপনিও কি শোনেছেন? নারে পাগলা, আমি শুনিনি, আমি দেখেছি। হ্যা হ্যা, আমি দেখেছি। আমাকে স্বয়ং রব-তায়ালা-ই লা-মকানে নিয়ে দিদার দিয়েছেন। সমগ্র সৃষ্টি আমার পদতলে ছিল। আমি সীমা ছাড়িয়ে অসীমে চলে গিয়েছিলাম। সুবহানাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার!

শেষকালে একটা প্রশ্ন রেখে যাই, যাঁর চোখে স্বয়ং খোদা গায়েব নয়, তাঁর আর দেখার, জানার বাকি রইল কী?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...