সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পথে পথে

পথে পথে-১

মগবাজার রেলগেটে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজন। আমি, গালিব-দা আর আসিফ। বইমেলার দিকে যাবো। তিনজনেই এক রিকশায় চেপে বসলাম। ভাড়াটা সর্বোচ্চ ৭০-৮০ টাকা হবে হয়ত! আমাদের সাইজ দেখে রিকশাওয়ালা চেয়ে বসল ১৩০! কারণ, স্বাস্থ্যগতভাবে তিনজনেই বেশ রোগা!

আমি আর গালিব-দা যা-তা, আসিফের অবস্থা আগা আবদুর রহমানের চেয়ে কোনো অংশে কম না (আগা আবদুর রহমানকে জানতে সৈয়দ মুজতবা আলির ‘দেশে-বিদেশে’ পড়ুন)। আগা আবদুর রহমান আফগানিস্তানের ভার বইতে পারুক আর না পারুক, আমাদের আসিফ যে পুরো বাংলাদেশকে একা টেনে নিয়ে যেতে পারবে—সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। যেখানে সে রিকশায় চড়লে তার পা রাখার জন্য আলাদা রিকশার প্রয়োজন, সেখানে আরও জুড়ে বসেছি আমরা দুই আধ-পেহলোয়ান।

আমি আর গালিব-দা দুজন দুপাশে। আমি বামে, গালিব-দা ডানে, মাঝে আসিফ। তার এক পা অসহায় রিকশার ডান চাকার উপর, অপরটি আমার আর গালিব-দার মাঝে চীনের মহাপ্রাচীর হয়ে কাজ করছে। যেন তা চীন-ভারতকে বিভক্ত করেছে। বলে রাখি, এখানে চীন আর ভারত মূখ্য নয়, মহাপ্রাচীরই আসল কথা। সেই মহাপ্রাচীরের ধাক্কায় দুজন দুদিকে পড়ি পড়ি অবস্থা। তার উপর আমার দুহাতে দুটি ভারী ব্যাগ। বাঁ-হাতের ব্যাগটা ঝুলে আছে। মনে হচ্ছে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়টা একহাতে বয়ে চলেছি।

মানবিকতার চরম বিপর্যয় আজ। গালিব-দাকে তার উক্তি মনে করিয়ে দিলাম—“যে মানবিক না, সে ধার্মিক না”। বললাম, আপনি একটা অধার্মিক। তিনি উল্টো জিজ্ঞেস করলেন—তোরা? বললাম, আমরা অধার্মিকের দুজন ধার্মিক ছোটভাই। তিনি আবার জানতে চায়লেন, তোরা ধার্মিক কীভাবে? তাকে জিজ্ঞেস করলাম—ধর্ম কী? তিনি জবাব দিলেন—“ধর্মাবতারের কথা মানা। যিনি ধর্ম নিয়ে আসেন, ধর্ম শেখান, তাঁর পথে চলা।” বললাম, “আপনি আমাদের ধর্মাবতার। আমরা আপনাকে অনুসরণ করেই রিকশায় ওঠেছি। অতএব, আমরা ধার্মিক। কিন্তু আপনি নিজের ধর্ম নিজেই মানেননি; তাই আপনি অধার্মিক।” তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস টেনে আকাশের দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন—“হায়রে ধর্ম, তোরে সবাই নিজের স্বার্থ-বরাবরই মানে, ধারণ করে না কেউ-ই।”

রিকশাওয়ালা মামার দিকে তাকিয়ে করুণা হচ্ছে। সাথে তার হিম্মত দেখেও অবাক হচ্ছি। নাহ, একে রিকশা চালাতে দেয়া ঠিক হয়নি। যে দুপয়সার জন্য এত ভার বইতে প্রস্তুত, তার কাঁধে নিশ্চিন্তে দেশের কোনো গুরুভার তোলে দেয়া যায়। বিপত্তি হচ্ছে—আমাদের টানতে গিয়ে তার টলমল অবস্থা। তার স্বাস্থ্যও আবার আমাদের বিপরীত। বুঝতেই পারছেন—অবস্থা কাহিলের চেয়েও কাহিল।

কিন্তু কাহিলকে সহজ করে দেয়া আমাদের আধমিনিটের কাজ। রিকশাওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দিলাম। বললাম, ‘মামা, মাফসাফ করে দিয়েন। এ পাপের ভার সওয়া সম্ভব না। কবরে ফেরেশতারা কোন পিডান পিডায় আল্লাজানে!’ সে মনেমনে কী গালাগাল দিচ্ছিলো কে জানে; কিন্তু মুখটা পেছনে ফিরিয়ে দেড়হাত লম্বা একটা হাসি দিয়ে বললো “কী যে কন মামা! এই রিশকা আর মুই মিলিয়া কত মাল যে টানছি, তার কী আর ইশেব আছে? এইলা কোনো বিষয় অইল?”

তার ভাষা শোনে গালিব-দা বললো—আপনি নিশ্চয় রংপুরের। ঠাড়ায় বক মরলো। ঢিল আঁধারে মারলেও জায়গা বরাবরই পড়েছে। রংপুরের নাম শোনে তার চেহারার ভাবসাব পাল্টে গেল। তাকে এতই উৎফুল্ল দেখালো যে, মনে হলো—সে রিকশাচালক না, পাক্কা পাইলট। তার রিকশাও মুহূর্তে প্লেনের গতি লাভ করলো। পুরোনো দিনের গানটি মনে পড়ছে—“চলে আমার রিকশা হাওয়ায় ভেসে ওইড়া ওইড়া”।

তার মুখ দিয়ে কথার ফোয়ারা ছুটেছে। তাকে আর কে থামায়! গালিব-দা ইশারা করলো—থামাইস না। খৎনা করানোর সময় ডাক্তার যেভাবে বাচ্চার মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যায়, সে কায়দায় দুষ্টু-মিষ্টি আলাপে তাকে বুলিয়ে রাখলাম পুরোটা পথ...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...