সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জ্ঞানের দরজা

আলি রা. জ্ঞান-রাজ্যের দরজা। তো সে রাজ্য কেমন? দরজার মাহাত্ম্যই বা কী?

একটা হাদিস দিয়ে শুরু করি। হাদিসটি অনেকের জানা। একদিন ফজরের নামাজ পড়ে নবিজি মিম্বরে দাঁড়ালেন। বলা শুরু করলেন সৃষ্টির শুরু থেকে। শুরু মানে একেবারে শুরু। যখন নবিজির নুরের সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকে। বলতে বলতে জোহর হলো। জোহর নামাজ শেষ করলেন। আবারও মিম্বরে দাঁড়িয়ে গেলেন। যেখানে থেমেছিলেন সেখান থেকে আবার শুরু। এভাবে আসরও অতিক্রান্ত হলো। বক্তব্য চললো সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত। পুরো একদিন। এই সময়টাতে কতটুক বললেন তিনি? আবু যায়েদ আনসারি (রা.)র ভাষ্যমতে জান্নাতিরা জান্নাতে, জাহান্নামিরা জাহান্নামে যাওয়া পর্যন্ত।

যদি বলেন—এটা সম্ভব না। এই অল্পসময়ে এত বিশাল বর্ণনা কীভাবে দিলেন? দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে। এক: তিনি সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন। দুই: সময় তাঁর অনুকূল হয়ে গিয়েছিল। সময় তো কারও জন্য অপেক্ষা করে না। তাহলে সময় অনুকূলে আসা বিষয়টা কেমন? ঐ যে এক রাতে ২৭বছরের মেরাজ করে আসার মতো আর কী! সময় আর স্রোত কারও জন্যে অপেক্ষা করে না—এই থিউরি আম জনতার জন্যে। কারো কারো জন্য সময় আর স্রোত দুটাই থেমে যায়। গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জন্য স্রোত থেমে যাওয়া ঘটনা তো এই সেদিনের। গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর জন্য স্রোত থামলে খোদ নবিজির জন্য সময় দীর্ঘ হওয়া? এ তো ডালভাত! একেবারেই সিম্পল।

আরেকবার উপরে ফিরে যাই৷ তিনি ঐদিন সবকিছুর বর্ণনা দিলেন। সবকিছু মানে সবকিছু। সবকিছু বর্ণনা করার জন্য সবকিছু জানা আবশ্যক। না-জানলে যেহেতু বর্ণনা অসম্ভব। এবার আপনি চোখ বন্ধ করুন। সৃষ্টির শুরুতে যান। ধীরে ধীরে নিচে আসতে থাকুন। নবি, আরশ, কুরসি, লৌহ, কলম, জমিন, আসমান, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড, আদম, শীষ, সোলাইমান, মুসা, ঈসা, নবিজির আগমন, সাহাবি, তাবেয়ি, প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ, আপনি... এরপর? নাহ, এরপর আপনার দ্বারা আর আগানো সম্ভব না। থেমে যান। আর যায়েন না। আপনার জন্য আর সামনে যাওয়া সম্ভবও না। এই যে, আপনি এত লম্বা ইতিহাস ভেবে আসলেন। এতকিছু আপনি জানেন। এই জ্ঞানের পরিসীমা ঠিক কতখানি? কতটা জানেন আপনি? ভাবুন, গভীরভাবে ভাবুন। নবিজি যা বললেন আর আপনি যা জানেন—দুটার তুলনামূলক পার্থক্য করুন। কী পাওয়া যায়? আপনি কী পেয়েছেন জানি না। তবে আমি এমনটা পেয়েছি—“আমি কিছুই জানি না”।

নবিজি সব জানেন। এজন্যই তিনি সবজান্তা। মদিনাতুল ইলম। জ্ঞানের শহর/রাজ্য। সে রাজ্যের বিস্তৃতি আশাকরি ইতোমধ্যে ধরে ফেলেছেন। খোদার খোদায়ীর পুরোটা আর কি। সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! আল্লাহু আকবর!

এবার একটু এই আলোচনাটাকে একপাশে রেখে দিন। জ্ঞানরাজ্যে ঢুকতে হবে। দরজার সন্ধান করা যাক। #পয়েন্ট_টু_ভি_নোটেড—“ঢুকতে হবে, দরজার সন্ধান করা যাক”। দরজার গুরুত্ব বুঝে আসতেছে তো? নবিজি জ্ঞানরাজ্য। নবিজির কাছে যাবেন? জ্ঞানরাজ্যে ঘুরবেন? দরজা লাগবে। দরজার খোঁজ করা লাগবে। দরজা যদি খোঁজে না-পান? পারবেন না। নবিজিকে পাওয়া সম্ভব না। নবিজি বলেছেন “আলিই সেই দরজা”। এবার দেখুন—আলি কেন সেই দরজা হবার সৌভাগ্য লাভ করলেন?

পৃথিবীতে একজনই এমন জন্মেছে, যার জন্ম কাবা শরিফে হয়েছে। তিনি মওলা আলি রা.। জন্ম থেকেই তাই তাঁর বাহাদুরি। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ। নবিজি ঘোষণা দিলেন—আমাকে এ উম্মতের নবি হিসেবে পাঠানো হয়েছে। সেদিন যে দশবছরের কিশোরটি বিনা-দ্বিধায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ পড়েছিল, সে বালককে আমরা মওলা আলি নামে চিনি। নবিজি হিজরতে যাচ্ছেন। কাফেররা তাঁর ঘর ঘিরে ধরেছে। সামনে পেলেই কতল করার হুকুম আছে। নবিজি বের হচ্ছেন। এক ব্যক্তিকে বললেন—তুমি আমার খাটে শোয়ে পড়ো! ঐ খাটে শুইলে কাফিরদের আক্রমণের সম্ভাবনা শতভাগ। মুহাম্মদ ভেবে তাঁকে হত্যাও করে ফেলতে পারে তারা। তবু বিনাবাক্যে চাদর মুড়ি দিয়ে সেই ব্যক্তি নবিজির খাটে শোয়ে পড়েছিলেন। জানেন তিনি কে? হ্যাঁ, তিনি মওলা আলি। হ্যাঁ, শুধু এই আলি রা. নামাজ পড়বে বলে নবিজির নির্দেশে ডুবন্ত সূর্য ফিরে এসেছিল। ইনিই সে আলি, যিনি একাই খায়বারের শাহি গেইট উপড়ে ফেলেছিলেন। ঐ গেইটের ওজন কত ছিল জানেন? চল্লিশজন বীর পালোয়ান লাগতো ওটা বহন করতে।

হ্যাঁ, ইনিই তো সেই সেই আলি, যাঁকে ধরাশায়ী করতে এক ইহুদি এসে বলেছিল, কুরআনে যদি সবই থাকে, আমার মুখে দাড়ি নেই কেন—এটা কোথায় আছে বের করে দাও। তিনি অবলীলায় কুরআনের আয়াত দেখালেন—“যে জমিন অনুর্বর, তাতে ফসল জন্মায় না”। তোমার মুখটা অনুর্বর, তাই দাড়ি গজাচ্ছে না। হ্যাঁ, তিনি জান্নাত-নেত্রী মা ফাতেমার স্বামী। নবিজি তাঁর ব্যাপারেই বলেছেন “আমি যার মওলা, আলিও তার মওলা”। নবিজি তাঁকেই বলেছেন, “আলি, তুমি আমার থেকে, আর আমি তোমার থেকে”। হ্যাঁ, এজন্যেই তিনি দরজা যে, একব্যক্তি এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন—এই মুহূর্তে জিবরিল আমিন কোথায় আছে? তিনি একবার উপরে একবার নিচে একবার ডানে আরেকবার বামে তাকিয়ে বলে দিয়েছিলেন—আপনিই তো জিবরিল! আরেকবার একজন জানতে চায়লেন—ইয়া আলি! আপনি কী আল্লাহকে দেখেছেন? জবাবে তিনি কী বলেছিলেন জানেন? “আমি ততক্ষণ পর্যন্ত নামাজ পড়ি না, যতক্ষণ আল্লাহকে দেখি না।” ওয়াল্লাহ, ওয়াল্লাহ!

তিনি আসলে কে? তাঁর পরিচয়টা আসলে কী? কার কাছে পাওয়া যায় এ উত্তর? মাওলানা রুমি তো মারেফতের অনেক জটিল অঙ্ক সহজভাবে বলে দিয়েছেন। চলুন, তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করি। রুমি উত্তর দিচ্ছেন—
“সাহসিকতায় তুমি ছিলে খোদার সিংহ—এইটুকু জানি,
পৌরুষত্বে আর বদান্যতায় তুমি কী— জানে তা শুধুই অন্তর্যামী।”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মটা যে ধর্ম নেই

ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক ধর্মটা যে ধর্ম নেই আর চর্ম কেবল আছে তা’য়, ধর্মমূলের কর্ম সকল দূর হয়েছে অচিন গাঁ’য়। জুব্বা টুপি পাগড়ি সবি বাড়ছে ক্রমে দিনে-দিন, মানুষগুলো হচ্ছে কেবল মুহাম্মদের ধর্মহীন (দরুদ)। তথ্যমতে নিত্য যারা গরীব-দুখীর ভাত মারে, গিয়ে দেখো ইদ-জুমাতে তারাই প্রথম কাতারে। যেই হুজুরে দিন-দুপুরে হালাল-হারাম বয়ান দেয়, দুই থেকে চার পয়সা পেলে ইমানখানাও বেইচা দেয়। পীর-সাধক আর ধর্মগুরুর বাড়ছে অভাব নিত্যদিন, পাত্র দেখে ছাত্র পোষে পীর নিজে বেশ ধর্মহীন। সহিহ হাদিস করছে হদিস দিনমজুর আর দিন-ফকির, মুহাদ্দিস আজ কলেজ-বালক ডাক্তারে-ও মুফাস্সির। প্রাথমিকের বাল-বালকে কাফের বলে রায় ছাড়ে, সোশ্যাল মামুর এই জগতে কার সাথে আর কে পারে! গাঞ্জা খেয়ে মঞ্চে উঠে পাঞ্জা দোলায় দেয় বয়ান, মোল্লা-মুনসির এই দশাতে যাবে কোথায় মুসলমান? কেউবা খেলে ফুটবল আবার কেউবা চড়ে রকেটে, দর্শকে কয় মারহাবা-জী হাদিয়া ভরুন পকেটে। সকাল থেকে রাত অবদি, রাত্র থেকে সকাল-তক, দীনটা ছিল সবটা-জুড়ে সবটা যেন থাকে হক। কর্ম যত ধর্ম সবি বলছে কুরআন মজিদে, অকর্মা...

পথে পথে-২

পথে পথে-২ ঢাকা থেকে মহানগর প্রভাতিতে চড়ে সোজা নারায়ণগঞ্জ বন্দরে পৌঁছলাম। সাথে আছে সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলা কাব্যে নবী-বন্দনা এবং নজরুলের মুনশিয়ানা’র লেখক আবু সাইদ এবং স্নেহাস্পদ মুকিম। যাবো আল্লামা বাকি বিল্লাহ (রহ.)র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া তৈয়বিয়া তাহেরিয়া মাদরাসায়। সামনে বুড়িগঙ্গা। পার হতে হবে। ঘাটে নৌকার হুড়োহুড়ি। দু-তিনজন মাঝি একসাথে ডাকাডাকি করছে—আয়েন হুজুর আয়েন। নিজেকে ভিআইপি ভিআইপি মনে হচ্ছে। পেছন পেছন আরও কিছু লোকের আগমন। মাঝিরা এবার আমাদের ছেড়ে ওদের ডাকছে। বুঝলাম—এ ঘাটে যারা আসে সবাই ভিআইপি। অতিরিক্ত ভাবসাব বাদ দিয়ে দ্রুত উঠে পড়লাম। উঠেই গান শুরু— “বাঁশখালিইইইই, মইশখালি      পাল উড়াইয়া দিলে সাম্পান গুরগুরাই টানে— হন হন যাবি আঁর সাম্পানে। কর্ণফুলীর মাঝি আঁই   নিয়ুম ভাটি-উজানে, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে ও তোরা, হন হন যাবি আঁর সাম্পানে।” মুকিম রসিকতার সুরে বললো—“ভণ্ডামি বাদ দেন ভাই, এটা কর্ণফুলী না; বুড়িগঙ্গা।” তার পিঠে কষে এক চড় দিয়ে বললাম—আবে হালা, ঢাকাইয়ারা বুড়িগঙ্গা নিয়া না-লেইখলে মুই কী করবাম? আবু সাইদের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। বাড়ি কুমিল্লা...

ধ্রুব

ধ্রুব ধ্রুব চা খাচ্ছিল। খেতে খেতে ভাবছে। ভাবতে ভাবতে খাচ্ছে। কোনটা আগে? ভাবনা না খাওয়া? খাওয়া না ভাবনা? আরে, এটা তো পান করার জিনিস; খাচ্ছে কেন? যাব্বাবা, কী যে মাথামুণ্ডু ভাবছে—কে জানে! পানকে খাওয়া ভেবে ভাবনার অপমান হয়েছে ঢের। আর না। এবার খাওয়ায় মনোযোগ দেয়া যাক। হে হে, মনোযোগ দেবার আগেই মনোভাব পাল্টে গেল? আবারো খাওয়া? ভাবনার মান-ইজ্জত একেবারে শেষ। কিন্তু না, এভাবে শেষ হতে পারে না। সে ভাবুক৷ ভাবনার অপমান সে হতে দেবে না। প্রয়োজনে পানকে যে-কোনো রীতিতে খাওয়া বানিয়ে ছাড়বে। আচ্ছা, চা’কে বিরিয়ানি ভাবলে কেমন হয়? হাঁ, বিরিয়ানি ভাবলেই হয়ে যায়। খাওয়া-পানের দ্বন্দ্ব শেষ। তা-ছাড়া চা আর বিরিয়ানির কালারটা কাছাকাছি। বিরিয়ানিতে ঝোল ঢালা হোক। মাখামাখি করে পান্তাভাত বানানো যাক। এবার পান্তাভাতের তরিকায় পুরুত পুরুত টানা যাক। আহা! সে কী স্বাদ, সে কী স্বাদ! ধ্রুব এবার চিৎকার দেয়—পৃথিবী বিরিয়ানির, পৃথিবী বিরিয়ানির। চায়ের কাপটা আর কাপ নেই। আকাশের বুকে সুসজ্জিত থালা। থালাটা আবার চাঁদের মতো। সে চাঁদে ঝিলিক মারছে। চাঁদটাকে একবার ডানহাতে, আবার বাঁহাতে। সেটাকে আবার কিছুক্ষণ পরপর মুখে পুরে লম্বা চুমুক। চু...