চেনা লোকালয়; অচেনা রূপ
—সৈয়দুল হক
বিকেল চারটা। বাস থেকে নেমে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। প্রায় দুমাস পর শহরের সাথে দেখা। দুমাস আগে কদিনের জন্য বাড়ি গিয়ে আঁটকা পড়েছি। লকডাউন শুরু হওয়ায় ফেরা হয়নি। গ্রামের এক কোণে পড়ে থাকতে থাকতে দম বন্ধ প্রায়। লকডাউন শিথিল হওয়ায় শহরে ছোটে আসা। সীমিত আকারে যানবাহন চলছে। বাসে উঠতে-নামতে মানা হচ্ছে বাড়টি সতর্কতা। আগেকার মতো ঝুলোনি আর দুলুনি খাবার সুযোগ নেই। দু-সিটে একজন বসছে। তাতে পঞ্চাশ টাকার ভাড়া উঠেছে আশি টাকায়। অবশ্য যাত্রীও অত নেই। না-হলে কি বাসে উঠে ঘণ্টাখানেক বসে থাকতে হয়...
লোকজন নেই রাস্তাঘাটেও। এই যে, মুরাদপুরের মোড়। এখানটায় গাড়ি আর মানুষের ভিড়ে ধম ফেলা কঠিন ছিল। লোকের হৈচৈ আর গাড়ির হর্নের অত্যাচারে বেশিক্ষণ থাকা-ই চ্যালেঞ্জিং। অথচ এখন কত শুনশান। রাস্তা কিংবা রেস্তোরাঁ—সবটাই ফাঁকা পড়ে আছে। কয়েকটা রিকসা আর হাতে গোনা কয়েকজন লোক ছাড়া আছে বলতে দৈত্যাকার বিল্ডিংগুলো আর ফ্লাইওভার নামের অঘোষিত স্থলসেতুটা। ফুট ওভার ব্রিজটায় ভিক্ষুকের ঠাসাঠাসি ছিল। দেখা যাচ্ছে না তেমন একটা। ভিক্ষা নেবেই বা কার কাছ থেকে৷ শহর যে জনশূন্য প্রায়।
ফ্লাইওভারের নিচে লোহার বেষ্টনী। রাস্তার ওপাশে যাওয়া যাবে না৷ দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে ওভার ব্রিজ হয়ে রাস্তাটা পার হলাম৷ সবগুলো রিকসাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে। একজনের চেহারা দেখে মায়া হলো বেশ। অনেকটা বৃদ্ধ। চেহারাটা শুকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে খাওয়া দাওয়া করেনি কয়েকদিন। ডাক দিলাম—
—মামা যাবেন?
—কোথায় মামা?
—চকবাজার।
—চলেন।
উঠে পড়লাম। বদঅভ্যাস আছে একটা। রিকসায় চড়লে রিকসাওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দেই৷ বহুদিন পর রিকসায় ওঠলাম। লোভ সামলাতে পারলাম না৷
—তো মামা, কেমন চলছে দিনকাল?
—কেমন আর চলবে মামা, আছি কোনোরহমে। আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখছে।
—মানুষজন তো নাই। তেমন ভাড়াও নেই আশাকরি।
—দুইটা থেইকা খাড়ায়া আছি। আপনিই বিকেলের প্রথম পেসেইনজার। সকালবেলা ছয়টা থেইক্কা বারোটা পর্যন্ত খাড়াইয়া থাইকা তিনডা পেসেইনজার পাইছি মাত্র। ভাইগ্যো ভালো, ইনকাম নাই দেইখা মালিকে ভাড়া নিতাছে না। না হইলে যে আমগোর কী অবস্থা অইতো—আল্লা মালুম।
—থাকেন কোথায়? পরিবারে কে কে আছে?
—থাকি অই কলোনিতে। গরিবের আবার পরিবার কী? বউ আর আমি। দুইখান মাইয়া। একটার বয়স পুনরো, আরেকটার তেরো। একখান মাত্র সাওয়াল। দশ বছরের। সে এখন কুলির কাম করে। টেকা পয়সা অল্পস্বল্প পায়৷
—তো, এখন আপনার ইনকাম কত?
—এহন তো ঐরকম ইনকাম নাই মামু৷ মাঝেমইধ্যে দুইশো, একশো পনচাইশ, আবার কোনো কোনো সময় একশো টেকাও হয় না।
—সংসার তাইলে চলছে কীভাবে?
—ঐ, খাইয়া না-খাইয়া। দুপুরবেলা ভাত খাই। রাত্রিতে পানি দিয়া পাউরুটি খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ি। বাঁচানোর মালিক তো আল্লাহ—বুঝেন নাই।
—শুনছি, সরকার মানুষের ঘরে-ঘরে ত্রাণ পাঠাইছে। আপনি পাননি?
—সে আর কী কওয়ার কথা মামু। ত্রাণ কি এখন গরিবে পায়? আমলারা সব চুরি কইরা রাইখা দেয়। গরিবরে দেয় না। ওরা গরিবের পেটে লাত্তি দিয়া চাইল ডাইল মাইরা খায়। ওরা কি ভাবছে, আল্লাহ দেখতাছে না? আল্লাহ সব দেখতাছে। একদিন ঠিকই অগো বিচার করবো।
ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আসলেই তো! এ পর্যন্ত তিনশোর উপরে ত্রাণচোর ধরা পড়ছে। না-জানি আরো কতজন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হায়, এ-সব অসহায়দের ক্ষুধার জ্বালা কি তারা একটুও অনুভব করে না? ভাবতে ভাবতে অলি-খাঁ মসজিদের মোড়ে এসে পড়েছি। রিকসাওয়ালার সাথে কথা আর বাড়ালাম না। ইচ্ছে করছিলো তাকে কিছু সাহায্য করি। কিন্তু উপায় নেই। দুমাস ধরে টিউশন বন্ধ। পকেটের অবস্থা ভালো না। ত্রিশ টাকার ভাড়া। পঞ্চাশ টাকার নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম—রাইখা দেন। তার শুকনো মুখে সূর্যমুখীর হাসি। সে হাসির প্রতিটা ছলকে কত পরিমাণ আশীর্বাদ ছিল—তা আর জানা নেই। তবে তার মুখ থেকে ভেসে আসা বাক্যটি এখনো কানে বাজে—‘আল্লাহ আপনার মঙল করুক’।
মুরাদপুরের মতো এখানকার অবস্থাও একই। টমটমে যাত্রী ও ছাত্র-ছাত্রীদের ‘কাকে মেরে কে ওঠবে’ টাইপ দৌঁড়ঝাপ নেই। দৌঁড়ঝাপ কী, টমটম-ই তো নেই। টমটমের-ই বা কাজ কী! জনশূন্য এই রাস্তার মোড়ে বসে বসে ঝিমানোর চেয়ে কারখানায় গা এলিয়ে ঘুমানো অশুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায়—‘উত্তমং পরমং’।
বাহন বলতে কয়েকটা রিকসা। তাও অলস বসে বসে মশা মারছে। ফুটপাতের চিরচেনা ব্যস্ততা খোঁজার চেষ্টা করলাম। সেখানটায় কয়েকটা কুকুর লেজ-নাড়িয়ে আমায় ভেঙছি কাটলো। লেজ নাড়ালো কেন বুঝলাম না। হয়ত খাদ্যের অভাবে ঘেউঘেউ করার শক্তি হারিয়েছে। অথবা ঘেউঘেউ করার মতো কাউকে না-পেয়ে নিজেদের ডাকটাই ভুলে গেছে এ কয়দিনে।
এখানে আর বেকার দাঁড়িয়ে লাভ নেই। বাসায় যাওয়া যাক। নাহ, বাসায় পরে যাওয়া যাবে। আগে কলেজের চেহারাটা একটু দেখে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ। হাঁটা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়লো—মুনতাসিরের বাসাটা আশেপাশে কোথাও। যাওয়া হয়নি বলে ঠিক চিনি না। মুনতাসির জুনিয়র। জুনিয়র হলেও অনেকটা ফ্রেন্ডলি। কল দিলাম— “হ্যালো, মুনতাসির! কোথায় তুমি? কী অবস্থা?”
—এই তো ভাইয়া, আছি ভালো। বাসাতেই আছি। আপনি কোথায়?
—মতি টাওয়ারের গোড়ায়।
—কী বলেন ভাইয়া, কখন আসলেন?
—এই তো, এইমাত্র। কলেজের দিকেই যাচ্ছি। বের হবা? চলো, আবু ভাইয়ের টঙে চা খাওয়া যাক।
—স্যরি ভাইয়া, এখন তো ঘর থেকে বের হতে দিবে না। আরেকদিন দেখা হবে ইন-শা-আল্লাহ! ভালো থাকবেন।
ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিল। ততক্ষণে গেইটে পৌঁছে গেছি। এ কয়দিনে প্রচুর পরিষ্কার জায়গায় শ্যাওলা জমলেও গেইটের বড়ো অক্ষরে “চট্টগ্রাম কলেজ” লেখাটা এখনো চকচকে আছে। কল দিলাম সোহরাবকে—“দোস্ত, কী অবস্থা? কই তুই?”
—এই তো, বাসায় আছি। কী অবস্থা তোর? কোথায় আছস?
—অবস্থা মোটামুটি ভালো। আছি কলেজ-গেইটে। এখনই আসলাম। তুই কি আসবি এদিকে?
—এখন?
—হ্যাঁ।
—স্যরি দোস্ত, এখন তো আসা সম্ভব না। বাইরে থেকে আসছস, গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ছস, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা কর।
সাইফিকে কল দিতে গিয়ে দিলাম না। ব্যাপারটা বোঝে নিলাম। আপাতত সবাই আমার সাথে দেখা করতে ভয় পাচ্ছে। দেখা হলেই যে ঝাপটে ধরি—হয়ত এটাই সমস্যা। বহু পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বহু লোকের সংস্পর্শ। বলা তো যায় না—করুণাহীন করোনা মহাশয় কোথায় লেপ্টে আছে! গাড়িতে উঠতে যে রডটা ধরে ওঠেছি, ওটায়? না কি সিটটায়? না কি প্যাসেঞ্জার থেকে একশো টাকা দিয়ে যে বিশ টাকা ফেরত নিয়েছি ওটায়? বলা যায় না। কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কথা ছিল, মুসতাসিরকে ফোন দিলেই এসে ঝাপটে ধরবে। ভাইয়া কেমন আছেন? দিনকাল চলছে কেমন? পরিবারের সবাই ভালো তো—ইত্যাদি হাজার রকমের প্রশ্ন ছোড়ে দিবে। মেসেনজারে কত কথাই তো হয় সোহরাবের সাথে। সুখ-দুঃখ শেয়ার হয় না কখন? অথচ এখন সামনে আসতেই ভয়! এই করোনা কাছের মানুষগুলোকে কত দূরেই না ঠেলে দিল। দুমিনিটের পথ; অথচ দূরত্ব অপরিমেয়। কেয়ামতের দিন নাকি আপনজনের কাছ থেকে অন্য আপনজন পালিয়ে যাবে। কেয়ামত কি তবে এসেই গেল? না কি এটা কেবল টেইলর? পিকচার আভি বাকি হ্যায়?
পিকচার বাকি থাকলে থাক। আপাতত ভেতরে যাওয়া যাক৷ কপাল-ভাগ্যে কলেজ গেইটটা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়লাম। বিকেলের এ সময়টা যেখানটায় বেঞ্চিগুলোতে বসে জম্পেস আড্ডা চলতো, সেখানটা এখন কাক-কুকিলের দখলে। চেনা লোকালয়ের অচেনা রূপ দেখে বুঝতে বাকি নেই—ওখানটায় এখন কাক-কুকিলের প্রেম জমছে। ওদের প্রেম দেখার অত শখ আমার আপাতত নেই। এক দৌড়ে তিনতলার বাংলা বিভাগে উঠে পড়লাম।
বারান্দা দিয়ে হাঁটছি আর জানলা দিয়ে ক্লাসের ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছি। একেকটা ক্লাসরুম আস্ত ভূতের বাড়ি। দেয়ালের কোণায় কোণায়, পিলারের গোড়ায় গোড়ায় মাকড়সার জালে ছেঁয়ে গেছে। টেবিলগুলো লোহার না গাছের বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে। ধুলোর আস্তরণ জমেছে কয়েক ইঞ্চি। ভালো করে দেখার জন্য মুখটা সামনে নিতেই ঠাস করে এক চড়। ভয়ে কয়েক হাত পেছনে ছিটকে পড়লাম। বারান্দায় দেয়ালের বেষ্টনী থাকায় বেঁচে গেলাম। নইলে সোজা নিচে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলাম ভূত কি আসলেই আসন পেতেছে এখানে? চড়টা মারলো কে? ভয় প্লাস ভয় একত্র করে ওটাকে সাহস বানানোর চেষ্টা করলাম। বিষয়টা একটু ক্লিয়ার হবার জন্য আবারো ভেতরে দৃষ্টি। অমনিতেই জানালার রড়ের উপর বাদুড়ের ঝাপটা। ও আচ্ছা, ভুত তাহলে তুমি? আর চড়টা? ওটাও চড় ছিল না ঠিক। ঝাপটাটা তখন অনেক কাছ থেকে ছিল বলে চড় মনে হয়েছে। ঠিক আছে মশাই, আমরা যেহেতু নাই; তোমরাই আপাতত এ রাজ্যের অধিপতি। চললাম...
কলেজকে বিদায় দিয়ে বের হলাম। হঠাৎ জাফরুলের ফোন।
—দোস্ত, কই তুই?
—এই তো, কলেজ গেইটে।
—তাইলে ঠিকাছে। ফেসবুকে তোকে ‘নেয়ার বাই’ দেখাচ্ছিল, তাই কল দিলাম।
—ও আচ্ছা, তুই কই?
—আমি হাসপাতালে। তুই কি রক্ত দিতে পারবি? এ পজেটিভ ব্লাড দরকার। পারলে চমেকে(চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) চলে আয় দ্রুত।
—আসছি...
কথা আর বাড়ালাম না। আসছি বলেই রওনা দিলাম। রক্ত দিয়েছি প্রায় চারমাস।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন