সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমার ভেতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আমি মানুষটা একা। ভীষণ ভীষণ একা। একাকী জীবনে আমার সঙ্গী কেবল একজনই। তার নাম ‘একাকীত্ব’। বন্ধুত্ব কী—সেটার সংজ্ঞায়নও আমার অজানা। সঙ্গী-সঙ্গ আমার কাছে কেবলই আভিধানিক পরিভাষা। কারণ, বন্ধু-বান্ধব, সঙ্গী-সাথি এ জীবনে হয়ে ওঠেনি।


ওঠেনি—তার পেছনে দুটো কারণ হতে পারে। প্রথমটা—আমার অযোগ্যতা। মানুষ হিসেবে আমি যে খুব একটা ভালো—সে কথা জোর দিয়ে বলতে পারি না। তাই যে কেউ আমার উপর খুব অল্পদিনেই বিরক্ত হয়ে ওঠে। অতঃপর ফোটে। ফোটে অর্থ এখানে ফুল ফোটা নয়; পালিয়ে যাওয়া।


আর যে একবার পালায়, তাকে এই জনমে দ্বিতীয় বার দ্বারে ঘেঁষতে দেখিনি। সৌজন্য রক্ষায় বন্ধুত্বের ভাব দেখায় কেবল; আরেঠারে ঠিকই বুঝিয়ে দেয়—“মুই তোমা ছাড়াই বেহাল তবিয়তে থাহি। চলার পথে পথেঘাটে তোমার ছায়া না-মাড়ালেই বাঁচি।”


দ্বিতীয় কারণটাই সম্ভবত প্রধান। আমি কোনোকালে খুব একটা পয়সাওয়ালা ছিলাম না৷ আমার পকেট ছিঁড়ে টাকা পড়েছে—এমন নজির নেই বললেই চলে। যে কয়েকবার পড়েছিল, তা পকেট ফুটো ছিল বলে; ওজনের কারণে নয়।


টাকা ছাড়া এখন পানিও মিলে না। তাই ‘পানির অপর নাম জীবন’ কথাটা এখন শুদ্ধ নেই। শুদ্ধটা হচ্ছে—‘টাকার অপর নাম জীবন’। জীবন যেখানে নেই, সেখানে বন্ধু আর বন্ধুত্ব অযাচিত কল্পনা। অতএব, আমার বন্ধু হওয়া, সঙ্গী থাকা—বিলাসিতা।


মনন জীবনে আমি চরম বিলাসী হলেও বাস্তব জীবনে সেই বিলাসিতা আমায় ধরা দিয়ে ওঠেনি। তাই একা একা চলি, একা একাই বলি। কখনো উদাস মনে রাতের তারা গুনি, কখনো বা দিগন্ত ছোঁব বলে ছুটে চলি। জোছনাতে ভিজি, বৃষ্টিতে নাচি। প্রখর রোদে স্নান করি; সন্ধ্যেবেলা গান করি। গভীর রাতে মশাকে ধরে বলি—কামড়াইস না—শরীর ভরা বিষ, খেলে তুই-ই মরবি। জোনাকির পেছনে এই বয়সেও দৌড়াই। হাতের মুটোই পুরে তার আলোর উৎস খুঁজি।


আর খুঁজি তাঁরে, যে এই নিঃসঙ্গ মানুষটারে এতগুলো সঙ্গী দান করেছেন। চরম নিঃসঙ্গ; তবু যেখানেই যাই, সঙ্গীর অভাব হয় না আমার। এই নীলাভ আকাশ, হৃদয় ছোঁয়া বাতাস, কাঠফাটা রোদ্দুর, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, পাখিদের কূজন, ঝর্নার ঝরঝর, নদীর বয়ে যাওয়া, সমুদ্রের বিশালতা, বৃক্ষের ঘনঘটা, সবুজের রঙতুলি—সবটাই আমার সঙ্গী। সবটাই আমার পরম বন্ধু। সবটাই আমার সকাল-বিকাল-সন্ধ্যে-রাত। মহাকালের মহা-আত্মীয়।


তাই ঐ আকাশের দিকে তাকিয়ে হৃদয় থেকে খুব অনুভব করি আজ—ছেড়ে যাওনি হে বিধাতা। একটা নিঃশ্বাসের জন্যেও আমায় একা করোনি। আমার ভেতর-বাহির সবটাতে মিশে ছিলে। প্রতি দৃষ্টিতে আমায় পথ দেখিয়েছো, প্রতি কদমে সাহায্য করেছ, প্রতিটি কাজে মনন থেকে বাতলিয়ে দিয়েছো—“এটা ঠিক, ওটা ভুল”।


তোমায় ভুলে ছিলাম। স্মরণে রাখিনি। দূরে ঠেলতে চেয়েছিলাম। শান্তি ছেড়ে শান্তি খোঁজে মরেছিলাম। “ওদ ও-নি আসতাজিব লাকুম” বলেছো বটে; কিন্তু ডাকার আগেই যে মননের অন্তে সাড়া জাগিয়ে তোলপাড় করেছো—সেটা একদমই খেয়াল করিনি। আমি আমার প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলেও তুমি একমূহুর্তের জন্য ভুলোনি—“নাহনু আকরবু ইলাইহি মিন হাবলিল ওয়ারিইইদ—আমি তোমার ধমনীর চেয়েও নিকটে।”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

হযরতের স্কুল-১

হজরতের স্কুল-১ –মুহাম্মদ সৈয়দুল হক “হাসরের দিন আমি সর্বপ্রথম বলিব– ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শিরক শিরক বলে মাইজভাণ্ডারের প্রতি আঙ্গুল তোলা ব্যক্তিরা গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারির এ বাণীটি অন্তরে গেঁতে রাখুন। অঘোষিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হজরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারি। সে ভার্সিটির পহেলা সবক ছিল “কবুতরের মত বাছিয়া খাও, হারাম খাইও না। নিজ সন্তানসন্ততি লইয়া আল্লাহর জিকির কর।”  গ্রামবাংলার আমজনতা সেসময় বিশ্ববিদ্যালয় বুঝত না৷ স্কুল বুঝত৷ তাই রমেশ স্কুল বলেছেন। এভাবে– “সেই স্কুলের এমনি ধারা, বিচার নাইরে জোয়ান বুড়া সিনায় সিনায় লেখাপড়া শিক্ষা দিতাছে মাস্টার ও মাহিনা ছাড়া, এলমে লাদুনি ভরা কাগজ কলম দোয়াত কালির কী দরকার আছে? গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারি স্কুল খুইলাছে...” রমেশ শীল হিন্দু ছিলেন। মাইজভাণ্ডারি গান লিখেছে প্রায় ৩৫০। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, তুমি আমাকে দেখা দাও’ টাইপের না। মানে গানগুলো কেবল গান না। এলমে শরিয়ত ও তরিকতের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য। সেখানে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত কোনটি নেই? যেমনটি লিখেছেন– “নামাজ রোজা কলমা আর, হজ ও জাকাত সার এই পাঁচ কাজে দাসগণে মশগুল রাখিও দয়াল ভাণ্ডারি ...

মসলকে আলা হযরত

বিষয়ঃ মসলকে আলা হযরতঃ একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা। —মুহাম্মদ সৈয়দুল হক শিক্ষার্থী: জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা। ফলপ্রার্থী: ফাযিল প্রথম বর্ষ ★প্রারম্ভিকাঃ  “তমসা ঘেরা এ দুনিয়ার মানুষ দেখিলো সেদিন পথ দীনের আকাশে উদিল যেদিন ‘মসলকে আলা হযরত’ বতুলতায় ভরা এ উপমহাদেশ পেয়েছে সেদিন দিশা রবিসম সে মসলক-গুণে কেটে গেছে অমানিশা।” যাবতীয় প্রশংসা সেঁ মহীয়ান সত্ত্বা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ নবির শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসেবে কবুলের পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ ইমাম আলা হযরত (রহ.)’র মসলকে কবুল করেছেন। অগুনতি দরুদ ও সালামের নজরানা সেঁ দুজাহানের বাদশা নবি মুহাম্মদ (দ.) এর পাক কদমে, যাঁর অশেষ করুণায় তাঁরই নির্ধারিত যুগের মহান দিকপাল ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (রা.)’র মসলকের শামীয়ানায় আমরা আশ্রিত। ইসলামের সকল যুগের সকল সূর্যসন্তানদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালামপূর্বক স্মরণ করছি যাঁর পথ-মত তথা ’মসলক’ নিয়ে লিখতে বসেছি, যুগের সে মহান সংস্কারক, আঁধারে আলোকরশ্মি, দোজকের তাপদাহে জান্নাতি পবন, অথৈ সমুদ্রে জাহাজের কাণ্ডারিতুল্য ইমাম আহমদ রেযা খাঁঁন ব্রেলভী (রা.) কে, যিনি এ পৃথিবীতে না এলে ইসলাম-সূর্য এদ্দিনে হয়ত তাঁর...

সত্যের আলোকবর্তিকা

সত্যের আলোকবর্তিকা      (শুভ জন্মদিন) যুবক হন্য হয়ে ছোটে। কখনও নগরের পথে কখনও বা বনবাদাড়ে। ছুটতে ছুটতে পা ফুলে যায়। রক্ত ঝড়ে। হুট করে বসে। জিরোই। আবার ছোটে। কখনও উথাল-পাতাল লাফায় তো কখনও ধীরস্থির শান্তভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় হযরতের রওজার কিংবা শূন্য আকাশে। বদ্ধঘরে একাকী দিন কাটে। নাওয়াখাওয়া নাই। হঠাৎ ঘর ছেড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায়—খোঁজে পাওয়া মুশকিল। পৌষ-মাঘের শীতেও দিনের-পর-দিন পানিতে ডুবে থাকে। গ্রীষ্মের উত্তপ্ত সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কারে যেন খোঁজে? কী যেন চায়? আমার আমি কই? কিংবা আমি কে? কোথা থেকে এলাম? ভেতরে কে আছে? তাঁকে জানা চাই, সাক্ষাৎ প্রয়োজন, চেনা লাগবেই। শরীরের রক্ত ছোটে, চামড়া ছেঁড়ে, জরাজীর্ণ হয়—পণ আর ছোটে না৷ হযরতের রওজায় সামা চলতো। ‘সামা’তে হালকা হয়। কোন এক অদৃষ্টের শক্তিতে শরীর দোলে উঠে। কাঁপন ধরে। কখনোসখনো সে কাঁপন লাফে গিয়ে ঠেকে। সামা শেষে যুবক আসলেন। শুরু হলো মারামারি৷ ‘যাকে পাই তাকে খাই’ নিয়মে চলছে মারধর। “নামাজ কালাম নাই? এত লাফালাফি কীসের? আবার সাজদা মারা হচ্ছে?” ভক্তকুল লে-ছোট। দৌঁড়ে কূল পায় না। ‘পড়ি কী মরি’ করে বাবাকে জানায়। বাবা...